একজন টিকটিকি (পর্ব – ১৬)

শুভ্রদীপ চৌধুরী on

ekjon_tiktiki

রোদ ঝলমলে দুপুরটা দুম করে নিভিয়ে দিল কেউ। আকাশ কালো হয়ে এল।  সত্যি সত্যিই ঝড় আসছে? 

বিছানা থেকে নেমে জানলার কাছে এল লিলি, যোগেনের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আমার একটা উপকার করবেন?

— বলুন।

— আমার  টেনশন থেকে প্রচন্ডরকম মাথা ব্যথা শুরু হয়। কিছুতেই স্থির থাকতে পারি না।আলো সহ্য করতে পারি না।

— চিঠিটা গোপন রাখব তা কথা দিয়েছি। আমি কথা দিলে তার নড়চড় করি না।

— আমি চিঠির কথা বলছি না। আমার ছেলের জন্য খুব টেনশন হচ্ছে। নিরুদি ওকে স্কুল থেকে আনতে গেছে। ছাতা নিয়ে যায়নি। আপনি একটা ছাতা নিয়ে প্রাইমারি স্কুলটায় যেতে পারবেন?

— পারব না কেন? খুব পারব। ছাতা দিন।

—দেখুন পাশের ঘরের বারান্দায় লম্বা কাঠের ব্রেঞ্চটার পাশে রাখা আছে। একঝলক বারান্দায় তাকালেই দেখতে পাবেন।

কাঠের হাতলওয়ালা সুতির কাপড়ের মস্ত একখানা পুরনো ছাতা হাতে নিয়ে যোগেন হাঁটা দিতেই লিলি চেঁচিয়ে উঠল, স্কুলবাড়িটা কোথায়, আমার ছেলের নাম কী, এসব না জেনে রওনা দিচ্ছেন? অদ্ভুত মানুষ তো আপনি!

খুব বড় ভুল হয়ে গেছে এমন ভান করে উঠোনে দাঁড়িয়ে পড়ল যোগেন।  লিলির ছেলের নাম বিলু। স্কুলটা কোথায় তাও জানা। এমন কী নীরু কখন আসে কখন যায় সব জানা তার। জগদীশ কখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় কখন ফেরে তার খবর অব্দি জানা। দীনবন্ধু বলেছিল, ভুল করলে তা থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসবে। কেন ভুল হল? এমন ভুল তোমার বারবার হয়। এসব  নিয়ে একদম কথা বলবে না। কথার চেয়ে মানুষ চেহারা দেখেই বেশি বিশ্বাস করে। মানুষ ভুল করলে যা করে তাই করবে। জিভে কামড় দেবে। মাথায় হাত দেবে। মাথা ঝাঁকাবে।

যোগেন জিভে কামড় দিয়ে  মাথা ঝাঁকাতেই  লিলি হেসে উঠল। থমথমে অন্ধকার হয়ে আসা এক দুপুরটাকে যেন তছনছ করে দিল সেই হাসি। যোগেন অপলক তাকিয়ে থাকল। এত সুন্দর হাসি সে আগে দ্যাখেনি। মনে হচ্ছে পা গেঁথে গিয়েছে উঠোনে। আর কোথাও যেতে পারবে না সে।

লিলি জানলার শিকে মুখ লাগিয়ে বলল, বড়বাজারের পাশের গলি দিয়ে যাবেন, স্কুলের নাম ক্ষুদিরাম এফ. পি। আমার ছেলের নাম সা…ক। ডাকনাম বিলু। আমায় দেখাশুনো করা নিরুদি ওকে আনতে গেছে। মনে থাকবে?

—- থাকবে।

— তাহলে আর দেরি না করে যান।

দ্বিধাগ্রস্ত যোগেন এগিয়ে যায়। আগের মত ছুটতে ইচ্ছে করছে না। পিছন ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করছে। খুব। ইচ্ছেটাকে আমল দেবে না ভেবে উঠোন পেরিয়ে সদর দরজার কাছে এসে আর পারল না। পেছন ফিরে তাকাল। আবছা দেখালেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সেও অপলক যোগেনের যাওয়া দেখছে।

যোগেন আর দাঁড়াল না। এগিয়ে চলল বিলুর স্কুলের দিকে। বারবার লিলির হাসি মুখখানা চোখের সামনে ভাসতে লাগল। শুধু হাসি নয় এক মাঝরাতে মুষলধারে বৃষ্টির ভেতরে কাঠের হাতলওয়ালা ছাতা মাথায় দীনবন্ধুর সঙ্গে সাধন বাবুর বাড়িতে যাবার কথা মনে পড়ল। হয়ত মনে পড়াল আজকের হাতলওয়ালা ছাতাটা। কথাগুলো মনেরাখা খুব জরুরি।মাঝ  চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দীনবন্ধু বলছিল, আমি পকেটে টিকটিকি নিয়ে ঘুরি বলে আমায় সবাই পাগল ভাবে। তাতে কিছু মনে করি না। যদি ওসব কথা পাত্তা দিতাম তবে আজ উদাস কে নিজের কাছে রাখা হত না। সবার কথা ধরতে নেই যোগেন।জীবন অনেক বড়। হাজার কথা আসবে যাবে। সব কিছুকে ঠেকে সরিয়ে মন যা বলবে তা কান পেতে শুনবে। আমি পারিনি। বহু ভুল করেছি। এখন আর ভুল করতে চাই না। একটার একটা ভুল হতে থাকলে জীবন আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে বেরিয়ে যায়। জেলে আমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল অদ্ভুত একজন মানুষের সঙ্গে। তার নাম অবিনাশ চাকলাদার। অবিনাশ কারুর সঙ্গে কথা বলত না। হাজার ডাকেও সাড়া দিত না। নিজে থেকে কিছু বলতে না চাইলে জোর করে তার মুখ থেকে কথা বের করা অসম্ভব ছিল। সেই মানুষ আমায় একদিন একটা লাইন বলেছিল, মানুষের জীবন ভয়ংকর করে তোলে হতাশা, আর হতাশার পেছনে থাকে আশা। জেল থেকে বেরিয়ে দিনের পরদিন হন্যে হয়ে কাজ খুঁজেছি তখন ভাবতাম আশা না থাকলে মানুষ এগিয়ে যাবে কী করে? কাজ জুটেছে টেকেনি। জেল ফেরত মানুষের কাজ টেকে না। তখন বুঝলাম জীবনের মানে আমি যা দেখছি। এইসব আশা আর হতাশার মাঝে মনের গভীরে ডুব দিয়ে দেখতে হয় আমার সবচেয়ে জরুরি কাজ কী? খুঁজে পেলে ওর মধ্যে ডুবে যাবে। যেমন আমি ডুবে আছি। আমার একমাত্র কাজ বহু পুরনো একটা  ঘটনা সামনে আনা। হরিমতি স্কুলে সেদিন টিকটিকির লেজ কাটা না পড়লে আমার তোমার প্রয়োজন পড়ত না। আমি ঘন্টা বাজা,  দরজা- জানালা বন্ধ করার কাজের মধ্যে ডুবে নিজের আসল কাজটাতে ঠিক এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ওখানে সবচেয়ে ভাল জায়গা ছিল লাইব্রেরিটা। নিরিবিলিতে বসে ছক করতে পারতাম। ছক করে চলতে জানতে হয়। লেজকাটার পর উদাস আমার দিকে মাথা উঁচু করে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। আর কাটা লেজটা নড়ছিল। আমি পালাব ভাবলাম। পারলাম না। পা গেঁথে গেছে। আসলে সবটাই মায়ার খেলা। মনে হল আমি আর ওই লেজ কাটা জীবটার মধ্যে কোনও ফারাক নেই। হাতে তুলে নিলাম। বাড়ি নিয়ে এলাম। মায়া বাড়তে থাকল। ব্যাংকে রাখা টাকার মত মায়া বাড়ে। মায়ার সঙ্গে সুদ জুড়ে যায়। এতটাই বাড়ে যা অন্যদের কাছে পাগলামি মনে হয়।

—গ্রামে শুনেছি খনার জিভ খেয়েছিল বলে সত্যি কথা শুনলে  টিকটিকিরা টিক টিক টিক শব্দ করে? ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, সঠিক বেঠিক সব নাকি যাচাই করতে পারে?

দীনবন্ধু হাসে। হাসতে হাসতে বলে, খনার বচনে এমন শ্লোক যা শুনলে তুমি নিজেই বুঝতে পারবে সত্যি-মিথ্যে।

— সেটা কী?

— হাঁচি টিকটিকি বাধা

   যে মানে সে গাধা।


ক্রমশ…


পড়ুন, এই ধারাবাহিক উপন্যাসের আগের পর্ব।


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


শুভ্রদীপ চৌধুরী

শুভ্রদীপ চৌধুরীর জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৮৩। গ্রামের নাম ইদ্রাকপুর। বাংলাসাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা। প্রথম গল্প প্রকাশ ২০০৪ সালে। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা সূত্রে বালুরঘাটে থাকেন। অক্ষরে আঁকেন গল্প। লেখকের কথায়, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যা শেখায়, "যা মনে করায় তার প্রতিচ্ছবিই আমার লেখা"। যোগাযোগঃ subhradip.choudhury@gmail.com

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।