শব্দস্রোত

প্রনব রুদ্র on

shobdoshrot

সকাল ৭টা ২০:

টুইইই টুইই… ট্রিপ্ ট্রিপ্… কিচ্ কিচ্… ঘুউউউ ঘুউউ… কাআআ কাআ… ট্রুরর ট্রু… আরো হরেক রকম দরবার। জানালার পাশে ব’সে প্রতীক। প্রকৃতি দেখছে। পাখিদের কিচিরমিচির কলতান শুনতে পাচ্ছে কিন্তু ওদের সবাইকে দেখতে পাচ্ছে না। বেশ কিছুদিন থেকেই শুনছে। প্রতিদিনই কমন কিছু ডাক শুনতে পায়। দু’একটা ছাড়া,বাকী পাখির ডাক ও বিশেষ চিনতে পারে না। ঘুঘু-কাক-চড়ুই আর কোকিলের ডাক বুঝতে পারে। এখন যেমন দৈবাৎ দু’একজন বন্ধু পরিজন আসে দেখা করতে।

দুপুর ১২টা৪০ :

আজ পাঁচদিন পর স্নান করেছে। শরীরে বিষ ব্যথা। একা একা পারেনা। ছায়া সাহায্য করে। খাওয়া দাওয়া শেষ ক’রে ওষুধ খেয়ে জানালার পাশে এসে বসেছে। পাশের বাড়ীর খুন্তি-কড়াইয়ের শব্দ ভেসে আসছে সাথে গন্ধও। আজ বুঝি সর্ষে ইলিশ হচ্ছে। প্রতিবেশী রাহাতকে ওর মা স্কুল থেকে নিয়ে ফিরলো। এতো তাড়াতাড়ি? প্রতীক শুনতে পায় মা ছেলেকে বলছে- “ আজ আবার বদমাসি করেছো, মিথ্যে কথা বলেছো ম্যামকে! পেট ব্যথা করছে? চলো ডাক্তার কাকুর কাছে, আজ ইনজেকশন দিতেই হবে তোমাকে!” রাহাত চুপ। একটা শব্দও করছেনা। মাথা নীচু করে আছে। তালা খুলে ঘরে ঢুকে দরজা লাগানোর শব্দ পাওয়া গেল ওদের। মুচকি মুচকি হাসে প্রতীক। আহা শৈশব! অবুঝ শৈশব! এবার ওর পেট ব্যথা শুরু হলো।

বিকাল ৫টা :

অল্প একটু সময় শুয়েছিলো। এখন বিছানার বালিশে ঠেস্ দিয়ে ব’সে। আয়ান-রাহাত-শানের গলা শুনে উঠে এসে বারান্দায় বসলো। এসময় প্রায় প্রতিদিনই ওরা খেলা করে। কোন কোনদিন প্রতীক ওদের খেলা দ্যাখে। ছয়-সাত বছরের বাচ্চাদের খেলা ঝগড়া-হাসি-দুষ্টুমি চেটেপুটে খায় ও। রাহাত বল কুড়াতে বারান্দার সামনে আসতেই জিজ্ঞেস করে- “কী বিদ্যাসাগর পেট ব্যথা কমেছে?”। “তোমায় একটা সত্যি কথা বলি মামা, আমার পেট ব্যথা করছিলো না। ইংরেজি ম্যামটা না খুব বকা দেয়। তাই ম্যাথ ক্লাসেই বুদ্ধি করে বলি পেট ব্যথা করছে, বাড়ি যাবো। তারপরই কাঁদতে থাকি।“- কথাটুকু বলেই রাহাত হাসতে থাকে, প্রতীকও যোগ দেয়। একটু দম নিয়ে “আসছি রবীন্দ্রনাথ মামা” বলে ও চলে যায়। রাহাত নিজেদের বারান্দায় বই-খাতা বগলদাবা করে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে আর মাঝে মাঝে চিৎকার ক’রে পড়াও করে গানও করে। তাই প্রতীক ওকে বিদ্যাসাগর ডাকে প্রত্যুত্তরে শোনে রবীন্দ্রনাথ মামা। কোথা থেকে একটা কোকিল উড়ে এসে নারকেল গাছটায় চুপচাপ বসলো। হঠাৎ প্রতীকের বমি বমি করতে লাগলো সাথে তলপেট জুড়ে প্রচন্ড ব্যথা। ব্যথার কোন শব্দ হয়না। কোকিলটা ফুড়ুৎ করে উড়ে গেলো!

রাত ১১টা ৪৫ :

রাতে একদমই খেতে ইচ্ছে করছিলো না। দু’একবার মুখে তুলে দিয়েছে ছায়া। ওষুধ খাওয়ার ছিলো বলে প্রতীক ওটুকু খেয়েছে। এখন বিছানায় চোখ বন্ধ ক’রে শুয়ে আছে। ঝি ঝি পোকার ডাক কানে আসছে। ফ্রিজ চলার শব্দও পাচ্ছে। রাস্তার কোন কুকুর দু’চারবার ঘেউ ঘেউ ক’রে এখন নীচুস্বরে ঘঅরর ঘঅঅররর করছে। একটা মোটর সাইকেল হুইসেল দিতে দিতে বেশ জোড়ে চলে গেলো। মনে হয় একটা বোঝাই লরি মেন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। শঅঅ শঅঅ চাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। তারপর ঘটাং করে চাকা খাদে পড়ার শব্দ কানে এলো। মেনরোডে চার রাস্তার কাছে বিদ্রোহী মোড়ে একটা খোয়া ওঠা জায়গা আছে। যতবার পিচ দিয়ে পাথর দিয়ে ঠিক করা হয় ততবারই কিছুদিন পর ওটা আগের মতো হয়ে যায়। রাতেরবেলা এরকম আরো দু’চারবার ঘটাং ঘটাং শব্দ পাওয়া যাবে। হঠাৎ কানে ঘরের দেয়াল ঘড়ির টিক্ টিক্ শব্দ ভেসে এলো। সকালেও তো দেখলাম সেকেন্ডের কাঁটাটা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে সামান্য একটু সামনে পেছনে নড়ার চেষ্টায় হাঁসফাঁস করছে এবং বিকেল পর্যন্তও মিনিট ঘন্টার কাঁটা স্থির দাঁড়িয়েই ছিলো। তবে কি ছায়া ব্যাটারি পাল্টে দিলো? নাহ্, ওকে তো কিছু বলাই হয়নি। টর্চটা হাতরে ঘড়ির দিকে আলো ফেলে দেখলো সেকেন্ডের কাঁটা এখন আবার ঠিকঠাক চলছে। তবে মিনিট আর ঘন্টা রাতের সময়ের সাথে মিলিয়ে নেই। আচমকাই শব্দহীন হয়ে গেলো চারপাশ। নিস্তব্ধ। নিঃশ্চুপ। সময় থমকে আছে। সময় পুড়ছে। রাত কী ভীষণ শুনশান! বান্ধববর্জিত। ছত্রিশ বছর বয়স তার। বিগত পাঁচমাস ধরে প্রাইমারি হেপাটিক ম্যালিগন্যান্সির চিকিৎসা চলছে। হাতে আর কত সময়, আদৌও সময় আছে? টিকটিকির ঠিক্ ঠিক্ শব্দে রাতের জমাট অন্ধকার খান্ খান্ হয়ে গেলো। আচ্ছা, চিতায় যখন পুড়বে এদেহ তখন কি এ শব্দস্রোত শুনতে পাওয়া যাবে; দরজার ওপারে কি যাবে শব্দের ঢেউ? চোখটা লেগে এসেছে। ঘুম নামছে পাতায়। সকালে ভাঙ্গবে এ ঘুম! মোবাইল হাতরে ঠিক করে দ্যাখে। ছায়া বলেছে কোন অসুবিধা হলেই ফোন করতে। ফোন করার সময় পাওয়া যাবে তো? নাহ্, অসুবিধার কি আর আছে- গাঢ় ঘুম নেমেই গ্যাছে চোখে। দেয়াল ঘড়ির টিক্ টিক্ শব্দ খুব কানে লাগে সারাদিন তাই ব্যাটারি বদলানোর কথা ও বলেনি ছায়াকে।

ঘড়ির কাঁটার প্রতিটি টিক্ টিক্ যেন জানাচ্ছে- সময় ফুড়িয়ে আসছে, ফুড়িয়েই যাচ্ছে দ্রুত…


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


প্রনব রুদ্র

"একদিন মরে যাবো বলে অজানা দিন বেঁচে আছি আর প্রতিদিনই জীবনপাত্র পান করছি।"

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।