সাদা ডানার ভেতর কালো মানুষের চুপকথা
কাব্যগ্রন্থ : জোকার , খিদে ও অন্যান্য পুতুল
কবি : কৌস্তভ কুন্ডু
প্রচ্ছদ : জিশান রায়
প্রকাশক : রঞ্জন আচার্য , নাটমন্দির
■ উৎসর্গ ও এক ট্রাপিজের খেলা
” ভিতরে লুকিয়ে রেখেছি মাছ
পারো তো লক্ষ্যভেদ করো “
মেরুদন্ড ক্ষয়ে যাওয়া এই সমাজে, যেখানে ডালভাতের মতো ঝিমিয়ে পড়ছে একের পর এক দু পেয়ে আত্মা, সেখানে দাঁড়িয়ে এ যেন এক প্রবল হুঙ্কার, প্রতিপক্ষের মুখে হুটখোলা চ্যালেঞ্জ। তবে এই ছুঁড়ে দেওয়া টোপ যে নিতান্তই বালকের ছেলেমানুষি নয় তা বুঝতে গেলে আপনাকে পাতা ওল্টাতে হবে। আর এই টোপ গিলতে গিলতে আপনি ভুলতে বসবেন যে ‘ শিকার ‘ করতে এসেছিলেন , না ‘ শিকার ‘ হতে। এই লক্ষ্যভেদ আসলে আমাদের মনের ভিতরে থাকা সাদা আর কালো পর্দার উপাখ্যান। যেখানে আমরা উড়ন্ত সব জোকার। ট্রাপিজের খেলায় ব্যালেন্স দেখাতে দেখাতে গিলে নিচ্ছি খিদে। মন ভুলিয়ে রাখতে খুঁজে নিচ্ছি পছন্দের পুতুল।
কাহিনীর শুরুতেই ( যদিও কবিতারই বই ) আমরা এক কালো মানুষের সাথে পরিচিত হই , যে তাঁর সাদা ডানার উপর ভর করে আমাদের নিয়ে চলে এক রোলার কোস্টার রাইডে । ছদ্মনাম এর আড়ালে যে খুঁজে চলেছে তাঁর প্রকৃত আইডেন্টিটি । কখনো ময়ূরের পালক , কখনো মোরগের পালক গোঁজা বহুরূপী – আসলে এক কৃষ্ণবর্ণ কাক ।
■ জ্বর ও ছায়া
” তাদের ছায়ার গন্ধে জ্বালিয়ে রেখেছি নীল আলো “
– ” ছায়ার গন্ধ ” ? এ এক অদ্ভুত বাঁকের মুখোমুখি এনে দাঁড় করায় । এমন শব্দ ভাবতে অর্ধেক জীবন চলে গেল – এমন বহু শব্দবন্ধ কাব্য জুড়ে । পড়তে গিয়ে বারবার মনে হয় এরাই কি তবে নতুন কিছু উপহার এই পৃথিবীকে ?
” কবিতা চিনির পাকে নিম নয় । আবার ফিল্মসং-শ্রোতার মানসিক তারল্যেরও সহযাত্রী নয় সে । মানুষের ভিতরের মানুষকে কবিতা আলোড়িত করতে পারে । ” – রঞ্জিত সিংহ ।
এই মানুষের ভিতরের মানুষকে বারবার আলোড়িত করে চলে এই কাব্যগ্রন্থের এক একটি পাতা । ” মাথার ওপরও যে একটা ঘর আছে / একতলায় না এলে বুঝতেই পারতাম না ” – কি ভয়ঙ্কর অথচ আপাত সাধারণ এই চিন্তা ।
” খবর পেয়েছ নাকি
আগুনেরও জ্বর হলো আজ
ঝরে যাওয়া পাতার ভেতর
সবুজ আলোর মতো এল জ্বর “
জ্বরের সময় আগুনের মতো তাপ শরীরে পেয়ে থাকি আমরা , কিন্তু আগুনেরও যদি জ্বর হয় – সেই চিন্তা কি এসেছে কখনো ? কবির এসেছে । তাই তিনি লিখতে পারেন এই লেলিহান শিখার আত্মায় ভর করে । মিথ আর মিরাক্যাল মিলে মিশে যায় । সবুজ আলোর মতো জ্বর আসে আমাদের । সন্দেহের নীল আলোয় মগজ ভরে যায় ।
” … কেও কেও
অপেক্ষায় আছে তোমার মৃতদেহে লাল পিঁপড়ে ছেড়ে দেবে বলে । মুখভর্তি ফেনা মেখে তুমি শুয়ে আছো ।
আহা কেউ তো চায় তোমার সে ছবি হোক
আজ সকালের ফেবু আপডেট । “
■ প্রকৃত ইলিশের শব
” কল্পনা , তুমি শ্রান্ত হয়েছ , ঘন বহে দেখি শ্বাস,
বারো মাস খেটে লক্ষ কবির একঘেয়ে ফরমাস “
– যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত
ফেবু খুললেই এই যে কবিতার পসরা সাজিয়ে প্রভাতের নৈবেদ্য অর্পণ , হাজার হাজার কবি আর কবিতার মাঝে চাপা পড়ে যায় প্রকৃত ইলিশের শব , তাঁরই যেন এক মৃত্যুঞ্জয়ী সংস্করণ এই কাব্যগাথা । তেমনই একটি কবিতা থেকে কিছুটা –
” কতগুলো সাদা ডানার ভেতর কালো মুখ নিয়ে হাসছিলাম । হাসতে গিয়ে মাথাতেই ছিল না – কালো মুখ , হলুদ দাঁত আর শ্যাওলা পড়া জিভের কথা । তাই কথা বলছিলাম বৃষ্টির মতো করে, আর পাইপ ফাটানো জলের চিৎকার ভেসে যাচ্ছিল বাড়ির বাইরে , রাস্তায় । “
কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয় , তাই শুধু নয় , তার সঙ্গে যাপনও মিশে যায় । মিশে যায় স্মৃতি , সত্ত্বা , ভবিষ্যত ও অতীত ।
” শিলালিপি ” কবিতার প্রথম দুটি স্তবক তেমনই ফেলে আসা ভালোবাসার গল্প বলে –
১
আগুন সাক্ষি ছিল না
ছিলও না দ্বিতীয় আর কেউ
তুমি ছিলে
তোমার মাথার অদৃশ্য সিন্দুর
২
পিছন ফিরে দেখি,
ডাকছ …
এখনও মনে পড়ে
এসে দাঁড়াও দরজায়
জীবনের প্রথম গার্হস্থ্য
জীবনের প্রথম সন্ন্যাস “
এই সন্ন্যাস , এই না হতে পারা গল্পরাই বারবার কবিকে আয়নার মুখোমুখি দাঁড় করায় ।
■ মিথ ও এক মুখপুড়ি
কবিতায় মিথের ব্যবহার , লোককাহিনীর ব্যবহার নতুন নয় । নতুন নয় এদের প্রসঙ্গ উঠে আসা । কিন্তু তা যখন কবিতার শরীর ও কবির মননের সাথে মিশ্রিত হয়ে রচিত করে এক নতুন আঙ্গিক , তা সর্প দংশনের মতোই শীতল করে যায় পাঠককে । ৯ টি কবিতায় তৈরি ” বর্জিত কবিতা ” নামক সেই মাস্টারপিস এর ৩ নং অংশে তারই ছায়া ভেসে ওঠে –
” তোকে দেখলেই দিনটা খারাপ যায় – এরকম একটা কু-বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছি । ঘটনা খারাপও যায় দিনটা । রাত গড়িয়ে আসে , আপাতত শান্ত শীতল ও অন্ধকার হয় পৃথিবী । গ্রাম জুড়ে ডাইনিরা জেগে ওঠে , পাঁচ-বহিনি , সাত-বহিনিরা দখল নেয় ধানখেত , কুলবন , ডবকা গড়ার মাঠ । তুই চুল খুলে নাচতে থাকিস আর আমি যজ্ঞকুন্ড জ্বালিয়ে রাখি মাথা সিথানের কাছে ।
ভোর হয় , খটখটে আলোয় শুকনো হয় সকাল । স্পষ্ট দেখা যায় তোর দেওয়া প্রাচীন অন্ধকার জড়ানো বাদামী দাগগুলো । “
ভালোবাসার এই মুখপুড়ি , ডাইনিকে নিয়ে অশ্বমেধ যজ্ঞে লিপ্ত হয়ে , প্রবল ক্রীড়া শেষে তাঁর নখের দাগ নিয়ে বাড়ি ফেরার দিনগুলোতে হয়তো ” এমনই দিন খারাপ যায় ” এর কু-বিশ্বাস কে বারবার আঁকড়ে ধরেছি ভীরু , কাপুরুষ হয়ে । সমাজভিত্তিক চাপে হাঁস অথবা ভদ্দরলোক হয়ে বেঁচে রয়েছি দিনের পর দিন ।
( এ প্রসঙ্গে ” পাঁচ বহিনি , সাত বহিনি “র লোককথাটি হলো এরকম যে – গ্রামাঞ্চলে পাঁচ জন অথবা সাত জন বিধবা মহিলার আত্মা , আসলে যারা আবার সম্পর্কে পাঁচ বা সাত বোন গ্রামের পথে পথে নিশুতি রাতে ঘুরে বেড়ায় এবং কোন একলা পুরুষকে পেলে তাঁকে ঘিরে ধরে ও তেনাদের মধ্যে যদি কোন এক বোন তাঁকে বিবাহ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন তাহলে বাকি বোনেরা সেই লোকটিকে মেরে ফেলে তেনার উপযোগী বানিয়ে নেয় । )
■ একলা যাপন
” মাথায় নিজেই হাত বুলিয়ে দিই এখন
বালিশ বুকের কাছে এনে জড়িয়ে ধরি বুকে
রাস্তায় হাঁটার সময় লক্ষ্য রাখি ‘ সঙ্গে থাকো ‘ ছায়াটাকে । “
নিজের সঙ্গে থাকা । “একলা এসেছি , একলা যাব ” – র এই পৃথিবীতে এ যেন এক প্রবল আত্মমগ্নতা । যেখানে নিজের ছায়াকেও হারিয়ে ফেলার ভয়ে আমরা কোণঠাসা । এই একলা যাপনের কথা বলতেই বলতেই কথক পৌঁছে যান স্মৃতি চারণে –
” মা শখের সেলাই করছে ,
আর ছুঁচ ফুটে যাচ্ছে হাতে ,
রক্তপাত হচ্ছে , সেলাইও চলছে “
রক্তপাতও হচ্ছে , আবার সেলাইও চলছে – এই লাইনটিতে এসে লেখাটি যেন অন্য এক জগতের সফর করায় । এ যেন সংসারের সেই অভিজ্ঞ সার্জেন , যিনি একের পর এক ক্ষতকে সেলাই করে বুজিয়ে দিচ্ছেন । শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অঙ্গকে প্রতিস্থাপন করছেন মাঝি-রূপ দক্ষতার সাথে । দুঃখ , কষ্টের ঘোলাজল থেকে টেনে বের করে আনছেন মাছ-ভাতের সুখ ।
■ উপসংহার ও আগামীর ব্যবচ্ছেদ
” পাহাড়ি শবর তুমি –
কোমরে সাম্রাজ্য দোলাও,
দু-পায়ে পুরুষ রাখো, দু-হাতে অস্ত্র সাজাও “
কাব্যগ্রন্থটির পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে এমন অজস্র মায়া, প্রশ্নচিহ্ন, রহস্য, ম্যাজিক রিয়ালিজম, প্রতিবাদ, আত্মদর্শন । দান্তে সম্পর্কে এলিয়টের বিখ্যাত উক্তি এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে – ” Genuine Poetry can communicate before it is understood ” । চার ফর্মার এই বইটি জুড়ে মোট ৫১ টি কবিতা। কবি কৌস্তভ কুন্ডু লক্ষ্যভেদ করতে পারলেন কি না তা সময়ই বলবে, তবে পাতার আড়ালে থেকে তিনি যেভাবে ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছেন, তা সামগ্রিক বাংলা কবিতাকে নতুন কোন পথ দেখাবে বলেই মনে করি ।
ভিনগ্রহী
ধরো তুমি ৪০ নম্বর বাসে উঠে গেছো । পৃথিবী থেকে বন্ধু- আত্মীয় প্রিয়জনেরা তোমাকে দেখছে । একটা মরু ঝড় তোমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এইমাত্র আড্ডার দিকে চলে গেল । একদল বৃষ্টি কিছু না বলেই দৌড়ে গেল খোলা ময়দানের দিকে । দেখলে অশ্বমেধের ঘোড়া দুটি তোমার ছোট্ট মফস্বল শহরে হ্রেস্বা ধ্বনি দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছে , আর ঘোড়ার নাল আঙুলে পরে দম্পতি যুগল হেঁটে বেড়াচ্ছে বিগ বাজার মার্কেটে । কিছুই করার নেই তোমার ; শীত বসন্তহীন পিছনের সিটে বসে থাকা ছাড়া । কন্ডাক্টর টিকিট কাটতে কাটতে তোমার কাছে চলে আসবে এরপর । পকেটে হাত দাও বন্ধু , দেখো খুচরা পয়সাগুলো দারুচিনি দ্বীপের কিনা ? “
ধূসর যোজনা
১
সমস্ত কঙ্কাল জুড়ে দু-মুঠো ভাত চাই মাংসের শরীর , শরীর প্রাণ পেলে জেগে ওঠে খেলা । এক পৃথিবী আপেল ঝরে পড়ে অন্ধকার খেলাঘরে । রাস্তা নাম দিয়ে ডাক দেয় মাটির পৃথিবী । তুমি শুধু তুমি নও আর ; ঝড় আসে চলে যায় ঝড় – মাঝখানে বিস্তৃত সময় ।
আর কিছু ? কিছু না তো । হলুদ ঘাসের কাছে বসে থাকে অন্ধকার বুড়োছায়া রঙ । সমস্ত পৃথিবী জুড়ে লেগে থাকে পেনসিলে আঁকা শুন্য মফস্বল ।
আয়ুর্বেদ
এভাবে অসুখের ভেতর দীর্ঘকাল ঘুমিয়ে থেকো না । উঠে এসো , দীর্ঘ এক তালগাছ থেকে ঘুড়ি হয়ে ডাকছি তোমাদের । শাপে বর ভোকাট্টা জীবন তোমার । আলো নেই , অন্ধকার শুন্য হয়ে গেছে । অসুখের ভেতর লাল দাগ খেতে খেতে বেয়াদপ হয়েছে বিশ্বাস ।
তবুও উঠে এসো । জবাফুল অন্ধ হয়ে গেলে , নিভে যাওয়া লাল আলো চটকালে নাকি পিচ্ছিল এক ওষুধের জন্মলাভ হয় ।
0 Comments