মেশিনে আটকে পড়ার পর

শুভ্রদীপ চৌধুরী on

mechine_atke_porar_por

অপরিচিত একটা শব্দ হবার মিনিট দুয়েক পর বুঝলাম কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। ঘামতে লাগলাম। মেশিনটা সত্যিই গিলে ফেলেছে আমার কার্ড। আমার পরিচয়, টাকা.. মাথা ঘুরতে লাগল।

আমি হেল্প, হেল্প করে চিৎকার করতে গিয়েও পারলাম না। মাথা কাজ করছিল না।পকেটে মোবাইল আছে সেটাই মনে নেই। মেশিনের কার্ড টেনে নেবার মুখটাতে চোখ লাগিয়ে দেখলাম। স্রেফ অন্ধকার। পাগলের মত ক্যান্সেল বাটনটা বার বার টিপতে লাগলাম। মেশিনের মনিটরে  বারবার সুন্দর একটা বাড়ির সামনে দাঁড়ানো হাসিমুখের স্বামী স্ত্রী আর একটা ফুটফুটে বাচ্চা, হোম লোনের টোপটা পালটে গিয়ে উঠে আসছিল কতগুলো হিজিবিজি অক্ষর। এদের মাঝেই আমার নাম লুকিয়ে আছে, আমার পরিচয়, টাকা..  সব।

  হেল্পলাইনের নয় নয় তিন ডায়াল করার কথা মাথায় এল অনেক পরে। ততক্ষণে মিনিট সাতেক পার করেছি। কাউন্টারের ভেতরের মিষ্টি গানটা আবার শুনতে পাচ্ছি।

‘এই তো সময়, এই তো সময়
হারিয়ে যাবার, নিজেকে পাবার
এই তো সময়,এই তো সময়’

একজন ফোন তুলল। গলাটা যন্ত্রের না মানুষের তা ঠিক বুঝলাম না। আজকাল এসব কেউ পাত্তা দেয় না।

যান্ত্রিক গলা আমায় বলল,অনুগ্রহ করে নিজের সমস্যাটির কোড নম্বর বলুন।

আমি বললাম ডিথ্রি।

— স্যরি,  আপনি ভুল কোড নম্বর বলেছেন।ডি থ্রি আমাদের পৃথিবী আর নেই।সঠিক কোডের জন্য আমি আপনার অপেক্ষা করছি। ওয়ান, টু,থ্রি, ফোর… টেন ।আপনার আজকের দিনটি শুভ হোক।

মোবাইলটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে হল।এমনি এমনি আমার চাকরিটা চলে যায়নি। টি কে দত্ত মানে আমার এক্স বসের মুখটা মনে পড়ল।অফিস থেকে বেরিয়ে যতটা খারাপ গাল দিয়েছি এখন মনে হচ্ছে আমার দোষ কম নয়। আমি ভুলে যাই। বিশেষ করে ডিজিট। চারটের বেশি মোবাইল নম্বর মনে রাখতে পারি না। কারো কারো নাম ভুলে যাই, বিজ্ঞাপনের মাঝে কোথাও একটা ডিজাইন রিপিট হতে দেখলেই মাথা  চক্কর দেয়। এক কলিগ কে বিশ্বাস করে বলেছিলাম।সে খবরটা ছড়িয়েছিল। ওরা এতদিন যা ভাবছিল, যা ভেবেনিয়ে গোপন আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল। তা আমি, আমার ডিজিটাল এক ডিজাইন বারবার দেখলে মাথা ঘোরার কথাটা ওদের জিতিয়ে দিল। আমার ইনবক্স ওরা ভরয়ে দিল অমন অসহ্য ছবি গুলো দিয়ে।এমনকি আমার অফিসের টেবিলের সামনে অমন ছবি টাঙানো হল। মানুষ কত কিছু থেকে  মজা পায়!

এবার স্ত্রী কে ফোন করলাম, হ্যালো,আমি আটকে আছি,ইয়ে…মানে… আমার কার্ডটা..এই একটু আগে, টাকা তুলতে গিয়ে, প্রথমে টুং করে শব্দ হল তারপর ওই সবুজ আলোটা আর জ্বলল না।

শুনতে পেলাম দুম করে ওর প্রিয় গানটা বন্ধ হয়ে গেল এবং বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে ও বলল, তুমি এখন ঠিক কোন এটিএমে।

আমি লোকেশন বলতেই ফোন কেটে দিল।

ও এমনটাই। ওর মর্জি বোঝা দায়,কখনো এত কথা বলে আবার কখনো এক্কেবারে চুপ মেরে যায়। সবটাই চলে নিয়ম করে। হয়ত সান ডে মন ডে খুব বকবক করল,পরের দুটো দিন ঠিক তার উল্টো।  সকালে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসবার আগের বেশ কিছু সিন মনে করে বুঝতে চেষ্টা করলাম ওর আসলে বকবক না স্টপ, কোনটা চলছিল!

সিন ওয়ান:

সকাল ( সময় মনে নেই)

আমি: আমি বেরুব। দশটার দিকে।

ও: দুপুরে ফিরবে?

আমি: জানিনা।

ও: ইয়েস অর নো!

আমি: নো।

ও: ওকে।

সিন টু:

চা খাবার সময়।

আমি: তুমি আজ কোথাও বেরুবে?

ও: শেষ বিস্কিটটা তোমার। নিয়ে নাও।

আমি: তুমি কোথাও বেরুবে আজ?

ও: জানি না।কেন?

আমি: না,  না, ঠিক আছে। এমনি…

সিন থ্রি:

স্নানের পর

আমি: আমার কিছু টাকা লাগবে। আছে কিছু?

ও: কত?

আমি : তিনশো মত,  আছে?

ও: দেখছি। না দেখে বলতে পারব না। তোমায় একটা,মেইল করেছিলাম সেসব আর্জেন্ট ছিল। আজ আবার সেই ফর্দটা লিখে দেব।

আমি: না,  না, মেইলটা দেখেই নেব।  ফিরবার সময় নেব।

তিনটে দৃশ্য পরপর মনে এল,তবু বুঝতে পারলাম না। তবে দ্বিতীয় অপশনটাই হবে। এসব আবোলতাবোল ভাবতে গিয়ে বুঝলাম মাথার জট ক্রমেই খুলে যাচ্ছে। স্বাভাবিক হচ্ছি, একটা হেড়ে গলা এখন গাইছে,

‘তোমার হাতে আমার হাত

সর্বনাশ,সর্বনাশ…..’

আবার নয় নয় তিন ডায়াল করলাম।এবার মনে পড়ল সমস্যা কোড, জিরো ফোর। বললাম।

উত্তর এল, আমাদের প্রতিনিধি আপনার কাছে কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাবে।আপনার দিনটি শুভ হোক।

আমি বাইরে এসে একটা স্মোকিং জোনে ঢুকে  সিগারেটের প্যাকেট থেকে বিড়ি বের করে জ্বালাই। টানি।ধীরেসুস্থে বের হয়ে আসি।হপ্তা তিনেক না কাচা ধূসর তেলচিটচিটে তোয়ালের মত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। যেন আকাশ দেখার কাজ পেয়েছি। একটা কাক দেখতে পাই।  চুপ করে বসে আছে ডায়মন্ডের একটা বিজ্ঞাপনে। বেশ কিছুক্ষণ পর আমি বুঝতে পারি কাকটা আসল নয়। ওটাও বিজ্ঞাপনের অংশ। তার কাজ বসে থাকা, বসে বসে দেখা।উড়বার জন্য তার জন্ম হয়নি।

লোকটা সে সময় আসে। ঢলঢলে জামা, প্যান্ট,সরু গোঁফ, আমার মতই রোগাপাতলা,পান খাওয়া লালচে দাঁত, চকচকে চোখ। ‘তথ্য সুরক্ষা দপ্তর  থেকে আসছি, আপনার আটকে গেছে?ঘাবড়াবেন না বের করে দেব। এটাই আমার কাজ।’

ঘটনাটার পর আমি এই প্রথম ওনার কথা শুনে হাসি।

লোকটা বলে, ‘একটা সিগারেট, বিড়ি কিছু থাকলে দিন। ভাত খাওয়ার পর সবে বিড়ি জ্বালাব কোম্পানির ফোন। রাতেও এমন হয়। মোক্ষম সময়ে কারুর না কারুর আটকাবেই । আমার বৌ হেব্বি খচে যায়। সব্বার বৌ খেপবে, স্বাভাবিক তাইনা!’

আমি মিটিমিটি হাসতে থাকি!

লোকটাকে বিড়ি দিই,লাইটার দিই, সে স্মোকিং জোনে যায় না। আমার সামনে দাঁড়িয়েই বিড়ি টানে। ‘ আমাদের পুলিশ ঘাটায় না। তাদেরও আটকে যেতে পারে!সব্বাই আজকাল ভয়ে ভয়ে থাকে কার কখন আটকাবে? খুব খারাপ সময়।একটু এদিক ওদিক করেছেন তো গেছেন।ডিজিটাল দেশে সাধারণ হয়ে ঘুরলে বিপদ।মন খারাপ করবেন না।’ কথা শেষ করে সে ফটাফট জামার বোতাম খোলে, প্যান্ট খোলে। পীঠব্যাগ থেকে একটা ঝকঝকে সাদা ড্রেস বের করে পড়ে নেয় এবং আমার নাম ঠিকানার কোড জেনে নিয়ে এটিএমের ডালা খুলে ঢুকে পড়ে।

এর পর আমার স্ত্রী আসে,  তার মুখ থমথমে!আমি এর চেয়েও থমথমে আশা করেছিলাম।

আমি আগ বাড়িয়ে বলি, তথ্য সুরক্ষা দপ্তর থেকে একজন এসেছে। উনি মেশিনের ভেতরে গেছেন প্রায় দশ মিনিট হল।চিন্তা কোর না উনি চিন্তা করতে নিষেধ করেছেন।আশাকরি, আর মিনিট দশেক পরে উনি চলে আসবেন।

— কতক্ষণ আগে গেছে লোকটা?

— বললাম তো, দশ মিনিট মত হবে।

–সত্যি!

–এই তো আমার হাতে সব দিয়ে উনি গেলেন।

আমার স্ত্রীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে এল, তোমার হাতে নিশ্চয় লোকটার ব্যাগ।ওতে ওর সব আছে?

কার্ড আছে?

— আছে।

— দারুণ, তবে চল মেশিনের ওই খোলা দরজাটা বন্ধ করে চলে যাই। তাড়াতাড়ি। ভেবে দ্যাখো তুমি কাজ হারিয়েছ এমাসেই…. কবে পাবে তার ঠিক আছে!এ লোকটার কাজ আছে!বেশ ভাল কাজ। সময় নেই, তাড়াতাড়ি কর।

আমি আবার ঘামতে থাকি। ওর চোখের দিকে তাকাই। চোখে চোখে বলার চেষ্টা করি, কাজটা ঠিক হবে? লোকটা!ওর কী হবে?

ওর চোখ জবাব পাঠায়, তুমি ভাল আছ? মনে রাখ ওই লোকটা যতটা ভাল আছে ততটা ভাল তুমি নেই। এবার বুঝেছ!

আমি মেশিনের ডালাটা বন্ধ করে দিই। বিড়বিড় করে বলি, তোর কাজ ছিল, আমার কাজ নেই.. বুঝলি।বাই।

বহুদিন বাদে বাড়িতে মাংস আনি।ঝালঝাল মাংস আর রুটি। রান্নাঘরটাকে প্রণাম করতে ইচ্ছে করে।আহা।

লোকটা বেশ পয়সা  জমিয়েছে!ওর কার্ড গলায় নিয়ে ঘুরি। ওর কাজে যাই।

আমার স্ত্রীর প্রিয় গান গুলি বাড়িতে বাজতে থাকে।

  ‘ আমায় ফুলের দেশে নিয়ে চল

আমায়  মেঘের দেশে নিয়ে চল

আক্যুরিয়মের মাছ, ও মাছ।

মাঝেমাঝেই মাংস আনি। বৌ জমিয়ে রাঁধে।ওর খাওয়া হলেই সে নিজে থেকে বলে তুমি এখনও মাংস খেয়েই যাচ্ছ আমার আর অপেক্ষা করতে ভাল লাগছে না। হাত ধুয়ে বিছানায় এসো।

আমি নাচতে নাচতে বিছানায় যাই, আর ওই লোকটার মানে এখন আমার কাজের ফোন বেজে ওঠে।কেউ আটকে গেছে…যাও..এক্ষুণি যাও।

দুপুর, বিকেল, ভোর, মাঝরাত্রি যখনই ওকে আদর করতে যাই কাজের ফোন বেজে ওঠে। বারবার।প্রতিদিন। আমি আটকেপড়া মানুষের কাছে ছুটে যাই। দেখি অন্য কেউ না, আমি আমি দাঁড়িয়ে আছি।সেই আমিটা ঘামছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলছে,  আমায় বাঁচান, আমার কার্ডটা..।


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


শুভ্রদীপ চৌধুরী

শুভ্রদীপ চৌধুরীর জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৮৩। গ্রামের নাম ইদ্রাকপুর। বাংলাসাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা। প্রথম গল্প প্রকাশ ২০০৪ সালে। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা সূত্রে বালুরঘাটে থাকেন। অক্ষরে আঁকেন গল্প। লেখকের কথায়, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যা শেখায়, "যা মনে করায় তার প্রতিচ্ছবিই আমার লেখা"। যোগাযোগঃ subhradip.choudhury@gmail.com

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।