একজন টিকটিকি (পর্ব – ১১)

শুভ্রদীপ চৌধুরী on

ekjon_tiktiki__11_1

জগদীশ আরেকবার উঁকি দিল, দীনবন্ধু লোকটা আগের মতই মেঝেতে থেবড়ে বসে আছে। পাশে  পুরনো একটা ট্রাংক। মাঝেমধ্যে কীসব বিড়বিড় করছে!
এস.আই বসাক স্যার এই আধপাগল মানুষটা থেকে সাবধানে থাকতে বলেছেন ভাবতেই জগদীশের হাসি পেল।

অন্তিম আজ কাজটা করতে নিষেধ করেছিল। সে নিজেও ভেবেছিল আজ নয় আর একটা দিন বাঁচুক!   কিন্তু ঠিকানায় পৌঁছে, লোকটাকে খুব কাছে থেকে দেখার পর দেরি করার ইচ্ছেটা গায়েব হয়ে গেল জগদীশের। এমনিতেই একা থাকে মানুষটা।
মিটার দেখার নাম করে ঢুকে লোকটার সুখিসুখি মুখ দেখে মেজাজটা ধরে রাখতে পারেনি জগদীশ। মিটারের কাছে গিয়ে মিনমিনে গলায় আসল কথা বলেছিল, স্যার, গলাটা শুকিয়ে এসেছে একটু জল খাওয়াতে পারবেন?
লোকটা কেন নয়, কেন নয় ছুটে গিয়ে একবোতল জল নিয়ে ফিরে এল। ভরা বোতলটা হাতে নিয়ে খাপটা শক্তকরে এঁটে  কিছু বুঝবার আগেই সজোরে মারল লোকটার মুখে। তারপর সেই একঘেয়ে কাজ। নিজে শব্দ করবে না অন্যকে করতে দেওয়া যাবে না, এই  ব্যবস্থা করে ফেলা।
জগদীশ অধিকাংশ ক্ষেত্রে অস্ত্র-টস্ত্র কাজে লাগায় না। মানুষের চারপাশেই যা ছড়ানোছিটানো থাকে তাতেই কাজ মিটে যায়।

মাঝেমাঝে সে নিজেকে শান্ত করতে বোঝায়, সুপারি কে দিয়েছে,  কে মরল এসব তার ভাবার কথা নয়। দুনিয়াদারি এভাবে চলে না। যে ছাপোষা সংসারী  লোকটা বগলে ব্যাগ নিয়ে গুনগুন করতে করতে  মাংস কিনতে রবিবারের সকালে বের হয় সে না জেনেই দিনের পর দিন সুপারি দিয়ে চলে! কেউ জানে না।

দীনবন্ধুর গলা ভেসে আসে।  ট্রেনটা শান্তাহারে আসার পর কী হল মা?
জগদীশ আর পাত্তা দিল না। এই লোক আধপাগল নয় পুরো পাগল। একা একা কথা বলে যাচ্ছে! লোকটাকে মাথা থেকে তাড়াবে। কখনই ভাববে না। দীনবন্ধুর ঘরের সামনে থেকে নীরবে বেরিয়ে  বড় রাস্তার দিকে হাঁটতে লাগল জগদীশ। বড় রাস্তার মুখে মস্ত একটা কদম গাছে। দুটো কমবয়সী ছেলে  গাছে উঠেছে।  ঝুরঝুর করে কদম রেণু পড়ছে মাটিতে। জগদীশ গাছের নীচে দাঁড়িয়ে বলল, দুটো ফুল দিবে ভাই?
ছেলেদুটোর কেউ কোনও উত্তর না দিয়ে ছোট্ট একটা ডাল পাতা সমেত খান চারেক ফুল ফেলে দিল।
জগদীশ হাসিমুখে ফুলগুলো নিয়ে বলল, ভাল থেকো ভাই। কদম খাবার সময় কথা না বলাই ভাল। পাপড়ি ফেলেদিয়ে রসকদম্ব খেতে আমারও খুব ভাল লাগে। ছোটবেলায় কত খেয়েছি। আজ আসি ভাই। আবার দেখা হবে।

কদম ফুল হাতে জগদীশ হাঁটতে লাগল।

দীনবন্ধু আবার বলল, তুমি আজ গল্পটা না বলে যাবে না। গল্প থামিয়ে মাঝপথে তুমি চলে যাও এটা ঠিক না মা।

মায়ারানী মন্ডল একদম নীচু গলায় শুরু করলেন, শান্তাহারের পর থেকে বলি, ওখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। দুজন উঠল। কেউ নামল না। গাড়ি ছাড়তেই সুমন্ত এগিয়ে এসে আমার সামনের সিটে বসল। আমি আগ বাড়িয়ে বললাম, নাটোরে গাড়ি থামলে লুচি, মিষ্টি কিনে আনবে। বড্ড খিদে পেয়েছে। অবশ্যই কাঁচাগোল্লা আনবে। আমার সামনের সিটের বয়স্ক ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলারা হাসতে লাগলেন। নাটোর এল। খাওয়া দাওয়া হল। পোড়াদহে আমরা নেমে পড়লাম। ঢাকা মেল ধরতে হবে। ওভার ব্রিজের দিকে হনহন করে হাঁটছি। বারবার পেছনে চোখ চলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ একজন পিছু নিয়েছে।
সুমন্ত চাপা গলায় আমায় সাবধান করে দিতে গুনগুন করে উঠল,
           ‘সে সুখের দিন কবে-বা হবে?
  টিকটিকি পূর্ণ লাহিড়ী ওয়ারেন্টো হাতে দেবে!’

আমি সাবধান হয়ে গেলাম। আমাদের ভাষায় গোয়েন্দা ইনস্পেক্টর পূর্ণচন্দ্র লাহিড়ী ছিলেন নষ্টের গোড়া।  এদের থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখতেই হবে।

ঢাকা মেল এল। উঠে পড়লাম। সুমন্ত বলল তুমি ঘুমিয়ে পড়,  গোয়ালন্দ এলে ডেকে দেব।আমি হেসে বললাম,  তুমি ঘুমোও আমি ডেকে দেব। সুমন্ত হাসল। কিছুক্ষণের মধ্যে কুষ্টিয়া এল। এর সুমন্ত ঘুমিয়ে এর আগের বার গোয়ালন্দের আগে গাড়ি ধীরেধীরে
চলছিল। যেন দম ফুরিয়ে এসেছে। জেনেছিলাম বালুচরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। নদীতে চর পড়লে স্টেশন দূরে চলে যায়। বর্ষাকালে কাছে চলে আসে। এবার আর দম ফুরিয়ে আসা নেই। দিনের আলো ছড়িয়ে পড়ছে। গোয়ালন্দ পৌঁছে দিল ঢাকা মেল। ওখানেই একজন আসবে আমায় নিতে। যার হাতঘড়ি বন্ধ ঘড়িতে ঘন্টার কাঁটা থাকবে তিনটের ঘরে আর মিনিটের কাঁটা দুইয়ের ঘরে।
কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর একজন বয়স্ক পুরুষ মানুষ হাসতে হাসতে এগিয়ে এলেন।ওনার বন্ধ হাতঘড়িতে দেখলাম তিনটে বেজে দশ।  আমরা স্টিমারে উঠলাম। স্টিমার ছাড়ার ঘন্টা পড়তেই বয়স্ক ভদ্রলোক চাপা গলায় বলল, যত দ্রুত সম্ভব নেমে পড়তে হবে।আই.বি আর ওদের টিকটিকি আছে। একে একে নেমে পড়।  আমরা পরের স্টিমারে উঠব। এটাতে আর একমুহূর্ত নয়। দ্রুত ভিড়ে মিশে নামতে থাকি। সুমন্ত ধরা পড়ে যায়। আর কখনও দেখা হয়নি।
যতটুকু জানতে পেরেছিলাম, সুমন্তের সঠিক পরিচয় জানার জন্য পুলিশ নির্মম অত্যাচার চালায়। এই নির্যাতনের ফলে সুমন্তর মুখের চেহারা পালটে যায়। আই.বি, চর, উপচর তার খোঁজ খবর নিতে ছোটাছুটি শুরু করে। যদিও সুমন্তর  পরিচয় উদ্ধার করতে পারেনি।
দেশ স্বাধীন হল। বিয়ে হল।

জানতাম না তোর বাবা আসলে কী কাজ করে। জানার পর রাগ করে বাবার বাড়ি চলে গেলাম। দুদিন পর তোর বাবা গিয়ে হাজির। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আমায় আবার ফিরে আনল। সবসময় মনের ভেতরে বাবলার কাঁটার দংশন হত, আমি কী পেলাম! চেয়েছিলাম দেশ স্বাধীন হোক। হয়েছে কিন্তু আমি ভাগ্যের খেলায় হয়ে গেলাম পরাধীন। পালিয়ে যাবার কথা ভাবতাম। পারলাম না।  তুই চলে এলি। বুঝলাম আর কোথাও যাবার নেই আমার। মন্ত্রগুপ্তির কথা আজীবন মেনে চললাম। নিজের সমস্ত পরিচয় মুছে ফেলে একজন ইংরেজের টিকটিকির স্ত্রী হয়ে কাটাতে লাগলাম।

— চলে গেলে না কেন আমায় নিয়ে কোথাও? তাহলে আমায় এই ভয়ংকর জীবন কাটাতে হত না।
— মেয়েদের সংসার ছেড়ে যাওয়া অত সোজা নয় দীনু। এক পা গেলে সাত পা পিছিয়ে আসতে হয়। বড় কথা হল আমি আমার শ্রদ্ধার বেশ কয়েকজন  মানুষকে ধীরেধীরে ক্ষমতার দিকে ছুটতে দেখছিলাম। তাদের এতদিনের লড়াই, জীবনবাজী রাখা, সততা সব কেমন যেন মিইয়ে গেল। তোর বাবা তখন বলেছিল, খারাপ মানুষ, ভাল মানুষ বলে কিছু হয় না মায়া। মানুষের মধ্যে সব হবার বীজ আছে। মন খারাপ কোর না, আগে যা করেছি তা আর কখনও করব না। কোনও দিন না। আমি লোকটাকে বিশ্বাস করতে শুরু করলাম।না করে উপায় ছিল না। কারণ, আমি বিধবা জেনে,বিপ্লবী জেনে সে আমায় বিয়ে করেছে।

— কাল তোমার বাবার বাড়ির গ্রামে যাব। সেখানে এক অদ্ভুত ছেলে থাকে। ওকে নিয়ে আসব। সেই ছেলের নাম যোগেন। আগাম বৃষ্টির খবর সে বলে দিতে পারে! ওকে আমার খুব দরকার।

দেয়ালে উদাস টিক  টিক টিক করে ডেকে ওঠে।

মায়ারানী মন্ডল উঠে দাঁড়ালেন।তারপর হাসতে হাসতে বললেন, তোর বাবা টিকটিকি নিয়ে মজার একটা গল্প শুনিয়েছিল। গল্পটা এই রকম, সৃষ্টিকর্তা গিরগিটিকে দিয়ে মানুষের কাছে খবর পাঠালেন, মৃত্যুর পর মানুষ আবার পুনর্জীবন লাভ করবে। এই কথা আড়ি পেতে শুনে ফেলল টিকটিকি। সে ঠিকমত না বুঝে তাড়াতাড়ি মানুষের কাছে এসে বলল, সৃষ্টিকর্তা বলেছেন, মৃত্যুর পর আর ফেরার উপায় নেই।
মানুষ তার কথা বিশ্বাস করে।
গিরগিটি এর অনেক পরে মানুষের কাছে এসে সব জানায়। কেউ গিরগিটির কথা বিশ্বাস করে না।
এখান থেকেই শুরু হয় মানুষের বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের গল্প। আজ যাই রে। তুই সাবধানে থাকিস দীনু।


ক্রমশ…


পড়ুন, এই ধারাবাহিক উপন্যাসের আগের পর্ব।


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


শুভ্রদীপ চৌধুরী

শুভ্রদীপ চৌধুরীর জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৮৩। গ্রামের নাম ইদ্রাকপুর। বাংলাসাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা। প্রথম গল্প প্রকাশ ২০০৪ সালে। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা সূত্রে বালুরঘাটে থাকেন। অক্ষরে আঁকেন গল্প। লেখকের কথায়, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যা শেখায়, "যা মনে করায় তার প্রতিচ্ছবিই আমার লেখা"। যোগাযোগঃ subhradip.choudhury@gmail.com

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।