আমরা দেখব না স্বপ্ন? (চতুর্থ পর্ব)
লম্বা সাদা দাড়ি, এক মুখ বসন্তের দাগ, মাথায় টাক, থ্যাবড়া বড় নাক। চোখ বন্ধ করে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে বালির ওপর, হাত দুটো মাথার পেছনে রেখে। জামা-কাপড় জলে ভেজা, যেন এই মাত্র সমুদ্র-স্নান করে উঠে এসেছে। সেদিন রাতের মত আলখাল্লা নয়, একটা ফিনফিনে ফতুয়া আর চেক–কাটা লুঙ্গি পরা। দাড়িটা উড়ছে সমুদ্রের হাওয়ায়। পায়ের পাতায় বালি। খুঁড়ো ভীষণ অবাক হল দেখে – বুড়োটা যেখানে শুয়ে, সেদিকে বালি ধবধবে সাদা। আর খুঁড়ো যেখানে আছে, সেদিকের বালি কেমন অদ্ভুত কালচে। খুঁড়োর একবার মনে হল বুড়োটা দেখে ফেলার আগেই এখান থেকে দৌড়ে পালাতে হবে। কিন্তু কোথায় পালাবে ভেবে পেল না। মনে হল এই সাদাবালি-ই লোকের চোখে দিয়ে আসছে বুড়োটা। এই সেই জায়গা। যদিও, ওর গায়ে সাদা বালি নেই… কালো বালি। কিন্তু কালো বালিতেও তো কিছু হতে পারে! হয়ত আরো ভয়ঙ্কর কিছু? মনে হতেই আঁতকে উঠল। নিজের গায়ে লেগে থাকা সব বালি ঝেরে ফেলতে শুরু করল পাগলের মত। ভিজে গা থেকে বালি ঝরে পড়ে না অত সহজে। নিশ্চিৎ মৃত্যুর মুখে প্রাণী যেমন শেষ-চেষ্টা করে, সেরকম ছটফট করে বালি ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করছিল খুঁড়ো… কালো বালির ওপর দাঁড়িয়েই। প্রতিটা ঢেউ এসে ওর পা একটু করে ডুবিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল বালির ভেতর। হঠাৎ কেউ বলে উঠল – “দরকার নেই… কিছু হবে না”
কথাগুলো শোনা মাত্র থেমে গেল ভেতরের ছটফটানিটা। খুঁড়োর দেখল বুড়োটা উঠে বসেছে, ওর দিকে তাকিয়ে আছে… সেই ঘোলা চোখ দুটো নিয়ে। বুড়োটা হাতছানি দিয়ে ডাকল, “দাঁড়িয়ে থাকিস না… আয়।” খুঁড়োও এগিয়ে গেল তার দিকে। এগোতে এগোতে থমকে গেল সেখানে এসে যেখানে কালো বালি শেষ, আর সাদা বালির শুরু। পা-টা এগিয়েও, রাখতে পারল না সাদা বালির ওপর। বুড়ো আবার বলল “থামলি কেন?… আয়?” বুড়োর গলার আওয়াজটা খুব মিহি। ব্যাটাছেলের এমন মিহি গলার আওয়াজ খুঁড়ো শোনেনি কখনো। আর কেমন একটা টেনে টেনে কথা বলে! হয়ত ইচ্ছে করেই খুঁড়োর সঙ্গে এভাবে কথা বলছে। খোকাদের ভোলাবার জন্য ছেলেধরাগুলো যেমন করে! তবু খুঁড়ো পালালো না, এগিয়ে গেল বুড়োটার দিকে… একদম পাশে এসে দাঁড়ালো সাদাবালির ওপর। সাদাবালিতে খুঁড়োর পা-দুটো আরো কালো লাগছিল। রোদ ফটফট করছে সাদা বালি, চোখ ধাঁধিয়ে যায়। হাতের ইশারার বসতে বলল বুড়ো। খুঁড়ো বসল… একটু দূরত্ব রেখে… উবু হয়। চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ করে একবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো বুড়োটা, তারপর খুঁড়োর দিকে তাকিয়ে বলল – ব্যথা করছে? খুঁড়ো একটু ভাবল… কোথাও ব্যথা আছে? বুঝতে পারল না। চুপ করে রইল।
— করছে? ব্যথা?
— না।
— কোত্থাও ব্যথা নেই?
— কোথায় ব্যথা করবে?
— মাথায়? পায়ে? পেটে?… মনে?
—
— খিদে পাচ্ছে?
—
— পাচ্ছে না? তেষ্টা?
— পেট গুলোচ্ছে…
— সাগরের জল পেটে গেছে?
— জানি না।
— ডাব খাবি? ওই দেখ… কাঁকড়া ঘুরছে… খাবি?
— কাঁচা?
— না না… কাঁচা খাওয়ার অভ্যেস চলে গেছে। জানি।
— আগুন?
— এনে দেব।
— খাবি?
—
— কী রে? অমন মাথা নীচু করে আছিস কেন?
— তোমাকে চিনি আমি।
— চিনিস? আগে দেখেছিস?
— অনেকবার… সব জানো তুমি!
— না… কেউ সব জানে না। আমিও না। ‘সব’ খুব জটিল জিনিস।
—
— ইস্কুলে গেছিস কখনো?
— পেরাইমারি… কেলাস টু…
— তারপর?
— মা…
— মরে গেল?
— না… চলে গেল। বোনকে নিয়ে।
— ও… তাহলে বুঝবি না।
— কী?
— মড়াকেও ‘শব’ বলে। বানান আলাদা।
—
— অনেকেই পালায়। আমিও পালাই… তুইও পালাবি। মানুষ মাত্রই পালায়। দুঃখ করিস না। লাভ নেই।
—
— কাঁদবি? বমি করবি? ঢেউয়ের দিকে চলে চলে যা।
— আমাকে ছেড়ে দাও না?
— ছেড়ে দিলে কোথায় যাবি? দোকানে?
— দোকান বন্ধ।
— তাহলে?
— জানি না।
— ফেরার জায়গা নেই, ছেড়ে দিতে বলছিস?… হা হা হা!
কথা বলতে বলতে ঠিক বুড়োর মতই বালির ওপর পা ছড়িয়ে বসেছিল খুঁড়ো। হঠাৎ খেয়াল করল, বুড়ো ওর সরু পা-টার দিকে তাকিয়ে আছে। পা দুটো গুটিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর একটু গলা তুলেই বলল “তুমি সালা ঢ্যামনা লোক একটা। আমার পোঁদ মারবে বলে ধরে এনেছ! দেখাচ্ছি সালা তোমায়!…” কথাগুলো বলতে বলতে খুঁড়োর বুকের ধুকপুক বেড়ে গেল, জোরে জোরে শ্বাস পড়ছিল। চারদিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল আর কেউ আছে কি না। অন্ততঃ কোনো দোকান বা গুমটি… সেদিকে পালাবে। লোক ডাকবে। বুড়োটা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিল। চোখদুটো ভালো করে কচলে নিয়ে বলল “যাআআ… যেদিকে যেতে চাস চলে যা।” নিরুত্তাপ উদাসীন সুর। খুঁড়ো কোথাও যেতে পারবে না জানে বলেই যেন ইচ্ছে করে বলছে। সত্যিই খুঁড়ো কোথাও যেতে পারল না… বালিতে ধপ করে বসে পড়ে বলল “আমাকেও তাহলে বালি দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবে? ঘুমের মধ্যেই মরে যাব… বলো?” বুড়ো কোনো উত্তর দিল না, দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা।
— কী হল… বল? এভাবে ঘুমোলে তো মরেই যায়… না?
—
— খাবার নেই, জল নেই… হাগতে-মুততেও পারছে না। মরবে না?
—
— হরিদার দোকানে শুনতাম… নাকি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছে সব। কেমন স্বপ্ন গো? খুব ভয়ের?
—
— তারপর ঠেলা মেরে ঘুম ভাঙাতে গিয়ে পটকে গেছে! আর সে জন্য আমাদের সব লাথিয়ে দিলো দোকান থেকে!
—
— স্বপ্ন দেখতে দেখতেই মরে যাব? ঘুমের মধ্যে মরলে কষ্ট কম হয়… না?
— সবাই স্বপ্ন দেখতে চায়। অথচ অন্যের স্বপ্নকে চিনতে চায় না… বিশ্বাস করে না। লোকগুলো নিজের মনের মত স্বপ্ন দেখছে… সহ্য হচ্ছে না!
— বাজে বকো না। তুমি ঢ্যামনামি করে চুলকে এসেছ। দিনরাত পড়ে থাকবে মরার মত। বাড়ির লোক ভয় পাবে না? লোকে ভয় পাবে না?
— একটু ভয় পাক… মাঝে মাঝে ভয় পাওয়া ভাল।
— তোমার কারো এমন হলে বুঝবে!
— তোর ইচ্ছে করে না, ক’দিন শান্তিতে স্বপ্ন দেখতে? রোজ যা দেখছিস, তার থেকে ক’দিন ছুটি নিতে?
—
— মাকে… বোনকে… দেখতে ইচ্ছে করে না?
— করে।
— স্বপ্নে দেখিস?
— মাঝে মাঝে।
— সেই শেষ যেমন দেখেছিলি…
— হুঁ।
— এখন দেখলে তোকে চিনতে পারবে ওরা?
—
— তুই চিনতে পারবি?
—
— ওই স্বপ্নগুলোই সব।
—
— এই লোকগুলো মরকের মধ্যে বেঁচে আছে। জানিস? খিদের জ্বালায় কুঁকড়ে ঘুমোয় রাতে। পেটভরে খাওয়ার মত স্বপ্ন দেখছে এখন।
— মরে যাচ্ছে… তোমার কুত্তামির জন্য মরে যাচ্ছে… মরবে কেন অ্যাঁ? কেন মরবে সালা!
খুঁড়ো লাথি মারলো বালিতে, ছিটকে গিয়ে বালি লাগলো বুড়োর মুখে। বুড়ো আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল… বালিগুলো ঝাড়ার চেষ্টা করল না। সমুদ্রের দিকে আঙুল তুলে খুঁড়োকে বলল… “ওই দেখ… জল বাড়ছে। ঢেউগুলো কেমন এগিয়ে এগিয়ে আসছে… শুকনো বালিও ভিজে যাচ্ছে।” খুঁড়ো শুধু থুঃ করে একটা থুতু ফেলল বালির ওপর। যেখানে থুতু ফেলল সেই জায়গাটার বালি কালো হয়ে গেল। বুড়োটা এবার লুঙ্গি ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল… “ঢেউ খুব জলদি বাড়ে… একটু পরেই সব জলের তলায় চলে যাবে। যাহ্… যেদিকে প্রাণ চায় চলে যা।” কথাগুলো বলতে বলতেই জলের ওপর যেন ভেসে উঠল বুড়োটা। ঢেউ এসে ওর গোড়ালি ডুবিয়ে চলে যাওয়ার কথা, কিন্তু বুড়োটা ঢেউয়ের ওপরে ভেসে ভেসে উঠল। ঠিক সেদিন রাতে ভেসে ভেসে এগিয়ে যাওয়ার মত!
— যাব কী ভাবে? কেউ তো নেই!
— কেউ থাকে না। একাই আসতে হয়, একাই যেতে হয়। আমিও থাকি না এখানে সব সময়।
— রাস্তা?
— ওই ঝাউবনের দিকে এগিয়ে যা… রাস্তা পাবি। যাহ্!
এই ‘যাহ্’ বলে পিঠে একটা ঠেলা মারল বুড়োটা… আর ধাক্কার চোটে খুঁড়ো অনেকটা এগিয়ে গেল। পেছনে ঢেউয়ের শব্দ আসছে, ঢেউ বাড়ছে। খুঁড়ো টাল সামলাতে পারছিল না। যেন সমুদ্রের ঢেউ ধাক্কা দিতে দিতে ঝাউবনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। প্রতিটা ঢেউয়ের ধাক্কা আগের ঢেউয়ের থেকে জোরালো। শেষবার বুড়োর গলার আওয়াজ পেলো… মিহি গলায় টেনে টেনে বিলাপ করার মত বলছে “সবাই খুব অধৈর্য। খুউউব অধৈর্য! কাআআরো তর সয় না। দু হপ্তাও তঅঅর সয় নাআআ!” একবার নয়, দু-তিনবার… হাওয়ায় কেটে কেটে যাচ্ছিল কথাগুলো… ক্রমে ক্ষীণ হয়ে এল বুড়োর কণ্ঠস্বর।
খুঁড়ো পেছন ফিরে দেখতে পেলো না বুড়োটাকে! চোখে-মুখে সমুদ্রের নোনা-জল ঢুকে যাচ্ছে। দম আটকে আসছে। শেষে একটা জোরালো ঢেউয়ের ধাক্কায় সামনে আছড়ে পড়ল খুঁড়ো। তারপর একের পর এক ঢেউয়ের তলায় তলিয়ে গেল ক্রমশ। ওপরে ঝাপসা জলের মত আকাশ… মা আর বোনের ঝাপসা মুখ। ওকে ওরা দেখতে পাচ্ছে না। দেখলেও চিনতে পারছে না!
পূর্ববর্তী পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
0 Comments