নরনারী কথা ( দ্বিতীয় পর্ব )
“সুখ নেইকো মনে,
নাকছাবিটা হারিয়ে গেছে হলুদ বনে বনে। “
আমরা ক্রমশ বড় হয়ে যাচ্ছিলাম। বন্ধুরা যে যার মত ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছিল নিজের নিজের জীবনে। মধ্যম মানের অনার্সের রেজাল্ট নিয়ে বাড়ির কাছের ইউনিভার্সিটিতেই এম.এসসি এর পড়াশুনো শুরু হলো আমার।
জুলাই মাসের শেষদিক তখন, থার্ড সেমেস্টারের ক্লাস সবে শুরু হয়েছে। আজকাল বড় আনমনা থাকি। একবছর আগেও কেমন ছেলেমানুষ ছিলাম, কিসব আবেগ রঙ্গন ফুলের মত দিন সেসব… কেমন প্রেম হয়েছিল আমার কৃশানুর সাথে কলেজের একদম শেষ দিকে! সেই সব গল্প ,দেখা হওয়া , রাত জেগে ফোন… আমি ক্রমশ গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ছিলাম ওর সাথে। ও ইন্টিগ্রেটেড এম.এসসি করতে চলে গেছিল দেশের এক বিখ্যাত ইনস্টিটিউটে।
প্রেম মানুষকে অন্ধ করে দেয়। কৃশানু বাইরে পড়তে চলে যাওয়ার পর মাঝে মাঝেই অদ্ভুত কথাবার্তা বলতো। একদিন বললো
— তুই ওরম গাঁইয়াদের মতো নাকছাবি পরিস কেন রে?
হীরের নাকছবিটা ক্লাশ নাইনে পড়ার সময় বাবার দেওয়া শেষ উপহার। খুব আদরের আমার, ও জানত সেটা। আমি বিশেষ কথা বাড়াইনি যদিও।
দুর্গাপুজোয় শহরে এসেছিল। বেড়িয়েছিলাম দুজনে অষ্টমীর রাতে। ওর হাত ধরে হাঁটছি শহরের অলিগলি বেয়ে। হালকা হাওয়ায় চুল উড়ছে অল্প অল্প। ও হঠাৎ বললো,
— রাঙা চুলগুলো স্ট্রেট করিয়ে নে। বেটার লাগবে তোকে একটু। কারলি হেয়ার এখন খুব আডট অফ ফ্যাশন।
অবাক হয়ে বললাম,
— বাবাঃ এত ফ্যাশন শিখলি কবে তুই? শোন না শাড়িটা কেমন হয়েছে বললি না? কেমন দেখাচ্ছে রে আমাকে? মা পছন্দ করে কিনে দিল। কত বললাম এত গভীর লাল ভালো লাগবে না আমায়,শুনল না।
একটু চুপ থেকে বললো,
— শাড়িটাই ঠিক আছে তোর জন্য। গাউন বা মিনিস্কার্ট এই চেহারায় ভাগ্যিস পড়িসনি…
হঠাৎ করেই খুব খারাপ লাগছিল। গলার কাছে একটা কষ্ট হচ্ছিল। সেদিন শুধু ওর জন্য সেজেছিলাম খুব যত্ন করে… আমার আর কোন ঠাকুর দেখতে ইচ্ছে করছিল না।
কৃশানু দ্রুত বদলে যাচ্ছিল।ফোন করতো না বিশেষ। মেসেজেরও উত্তর আসতো খুবই কম। আমি অপেক্ষা করতাম। নিজেকে বোঝাতাম নিশ্চয়ই খুব ব্যস্ত আছে ।
সরস্বতী পুজোয় এবার বন্ধুরা অনেকেই ছিল শহরে। বাড়িতে আমার ঘরে খুব আড্ডা দিচ্ছিলাম সবাই অনেকদিন পর। অনেকদিন পর আমার মনে হচ্ছিল সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছে। সন্ধের দিকে মোটামুটি সবাই চলে গেলেও কৃশানু ছিল তখনও। ওকে নতুন কেনা কবিতার বইটা দেখাবো বলে টেবিলের কাছে গেছি হঠাৎ ও আমাকে এক ঝটকায় নিজের দিকে ফিরিয়ে আমার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। আমি বুঝতে পারছি ওর হাত ক্রমশ আমার শরীরে আধিপত্য দেখাচ্ছে।সাংঘাতিক একটা তাপ উঠে আসছিল ওর শরীর থেকে। কেমন বিহ্বল হয়ে পড়ছিলাম। ও ক্রমশঃ আমার কাঁধ থেকে বাড়িতে পড়ার ঢিলে পোশাক ছাড়িয়ে নিতে চাইছিল, এক হাতে গলা চেপে ধরে। একটা কামড় জিভ ঠোঁট হাত দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এই কৃশানু কে আমি চিনি না, ওর স্পর্শ ঘ্রাণ কিচ্ছু চিনি না। অসম্ভব একটা কষ্ট লজ্জা আর ভয় ফিরে আসতে লাগলো। এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলাম নিজেকে। ওকে নিজের থেকে সরিয়ে দিতে দিতে বললাম
— কি করছিস কি কৃশানু?
ও একটু রাগ আর ব্যঙ্গ মেশানো গলায় হাঁফাতে হাঁফাতে বললো,
— কি করছি জানিস না? তুই ফ্রিজিড নাকি? আর কত সতীপনা দেখাবি? এক বছর ধরে প্রেম করছি আর ছুঁলেই তোর যত সমস্যা? তোর তো খুশি হওয়া উচিত তোর মতো মেয়ে আমার স্টেডি গার্লফ্রেন্ড। এত অহংকার কিসের রে তোর? তোর এই ন্যাকামো জাস্ট আর নিতে পারছি না বিশ্বাস কর। আই অ্যাম ভেরি অ্যালার্জিক টু সতী সাবিত্রীস…
কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে বেড়িয়ে গেল ও। আমি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ঘরে তখন পুরোপুরি সন্ধ্যে নেমেছে।
সম্পর্কটা আর ছিলনা তারপর…
কৃশানু চলে গিয়ে আমায় কবিতা দিয়ে গেছিল। প্রায়ই ফেসবুকে দেখি কৃশানু আর ওর নতুন বান্ধবীর ছবি। হালকা নিঃশ্বাস ফেলে আঙ্গুলের ধাক্কায় সরিয়ে দি। টুকটাক কবিতা পোস্ট করি। কখনো নিজের ফোটো দি না। কেমন যেন লাগে অপরিচিত লোকজন আমাকে দেখবে ভাবলেই।
এ বছর খুব বর্ষা নেমেছিল। আজ ডিপার্টমেন্ট যাইনি। আমার জন্মদিন ছিল। মা বলেছিল একটা নতুন শাড়ি পরতে। মা কে খুশি করতেই আজ একটা নীল শাড়ি পরেছিলাম। একটু কাজল, ছোটো টিপ আর ছোট্ট দু’টো রুপোর ঝুমকো। মা নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছিল পায়েস। কি মনে করে নিজের দু তিনটে ছবিও তুললাম ফোনের ক্যামেরাতে। এখন বেশ রাত। একটু একটু মন খারাপ লাগছে। কলেজে ওঠার পর এই প্রথম কৃশানু আমাকে জন্মদিনে ফোন করে নি। ফেসবুকে অন হতেই দেখি কৃশানুর একটা সদ্য পোস্ট করা ছবি। বান্ধবীর সাথে ডিনারের। হঠাৎ কেমন রাগ হলো আমার!আমিও নীল শাড়ি পরা একটা ছবি আপলোড করে ডাটা অফ করে শুয়ে পরলাম।কিচ্ছু ভালো লাগছিলো না…. আমার ২১ বছরের মনখারাপ মাখা জন্মদিন।
দিন সাতেক কেটে গেল। স্পেশালের ক্লাসের চাপ বাড়ছে। মাইক্রোবায়োলজির ল্যাব সেরে ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গেল। বাড়ি গিয়ে চা খেতে খেতে ফোনটা নিয়ে খুটখাট করছি দেখি কেউ একটা মেসেন্জারে মেসেজ করেছে
“chinte Parcho mam? Chinle friend request Ta accept koro plz… “
সত্যিই একটা ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট এসেছেও দেখি। প্রোফাইলটা খুলেই দেখি আরে এঁনাকে তো আমি চিনি! রাজর্ষি দত্ত। ছবিটা দেখে বেশ অবাক হলাম। সাদা Toque Blanche ( white hat) মাথায় পুরোদস্তুর সেফের পোশাকে দুহাত বুকের সামনে জড়ো করে হাসিমুখের ছবি। ওঃ তাই জন্য খাবার দাবার নিয়ে এত খুঁতখুঁত করা স্বভাব। অজান্তেই ঠোঁটের কোনে একটু হাসি ফুটে উঠল আমার । দোনামোনা করেও বন্ধুত্বের অনুরোধে হ্যাঁ করে দিলুম আঙুলের ছোঁয়ায়।
0 Comments