শ্রীখোল
সারাদিনের পরিকল্পনা ফিরে এল ব্যর্থ হয়ে। কড়া নাড়তে নাড়তে বলল- এখনও ভালো বায়না হয়নি’রে।
-জল খাবারের জন্যও সাধল না তোমার ম্যানেজার?
-একবার জিজ্ঞেস করেছিল, তবে…
-তবে! তবে কি?
-ওদের ঘরেই এতগুলো মাথা, ও রুটি খেলে জিভ পুরত;
-তাহলে কি আশা করেছিলে? ফিরে এসে খিদে সেঁকবে? তুমি জানো একবেলার বেশী আমি না খেয়ে থাকতে পারি না, বাপের ঘরে সে অভ্যাস আমার ছিল না।
-আহ্…আসতে, খোকা ঘুমচ্ছে!
-আর পেটের ভেতরে যে’টা জাগছে, সেটাকেও ঘুম পাড়িয়ে দেই বল?
-কীর্তনের দলটা এভাবে ভেঙে যাবে আমি কি জানতাম?
বলাইটা কোলকাতার কোন গানের দলে ভিড়ে গেল, …ভেবেছিলাম এই শীতে বায়না পেলেই নতুন টালি বসাবো।
-তা তুমি গেলে না কেন কোলকাতা? শম্পাদি বলছিল বলাইদা সপ্তাহে দু’শো করে পাঠায়, একটা নতুন উনুনও করেছে দেখলাম।
-নতুন উনুনে কি ভাত তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হয় বউ!
-আর তোমার ভাঙা উনুনে সকাল থেকে জল সেদ্ধ হচ্ছে!
-চাল একদম নেই?
-কাল অবধি চলে যাবে টেনে-টুনে। কচুর শাক করেছি; লঙ্কা কামড়ে খেয়ে নেবে চলো।
-গরম ভাত, কচুর শাক লঙ্কা দিয়ে-এ তো রাজার খাওয়া! হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ।
-এতো কৃষ্ণ নাম করো , এই তো তোমার কৃষ্ণ রেখেছে আমদের; তুমি যাওনা গো কোলকাতা, বলাইদা কে ধরে একটা গানের দলে জায়গা পাও কি না দেখ।
-বলাই বলেছিল বটে, কোলকাতায় আমাদের গানের ভালো চাহিদা; কিন্তু কি সব যন্ত্র-টন্ত্রের সাথে গাইতে হয়, লাইট,বড় বড় সাউন্ড বক্স, নিজের গলাই নাকি কানে শোনা যায় না মাঝে মাঝে। অত যন্ত্রের ভিড়ে আমি অন্তত কৃষ্ণকে পাব না, আর কৃষ্ণ কে না দেখল আমি তো গাইতে পারি না…. তুই জানিস। অষ্টপ্রহর কীর্তন হবে, খোল-করতাল বাজবে, হরির লুঠ হবে, তবেই আমি গাইতে পারি। কৃষ্ণপ্রেম ছাড়া কীর্তন হয় না কি! সারারাত গাইলেও তখন আমার ক্লান্তি আসে না, গলা ধরে না।
-বলাইদা তো ঠিক পারছে, যন্ত্রকে এত ভয় পাও কেন?
-ভয় ঠিক না, শুধু মনে হয় জোড়ালো শব্দের ভিড়ে যদি প্রেমটা হারিয়ে যায়!
-বড্ড সেকেলে প্রেম তো!
-কত কষ্টে বাপটা আমায় ‘হরি বোল’ শেখালো, তোর মধ্যে পেলাম বৃন্দাবন রস, খোকার মধ্যে গোপালকে। কোলাকাতা শহরে মাটি নাই, পা ফেললে যদি মাটি না পাই…
গানে সুর লাগে না আমার।
-থাক আর পিরিত দেখাতে হবে না; তাড়াতাড়ি চান টা সেরে এস, ভাত ঠান্ডা হলে কচু গলা দিয়ে নামবে না তোমার।
– তুই চিন্তা করিস না বউ, বাপ-ঠাকুরদা কীর্তন করেই বেঁচে খেল আমাদেরও চলে যাবে। হরিদেবপুরে শুনলাম তিন দিন ধরে পালা হবে, নতুন নতুন কীর্তনের দল আসছে, এ রাধেশ্যামের একটা জায়গা ঠিক হয়ে যাবে, পেটে এবার মনে হয় তুই লক্ষ্মী ধরেছিস বউ, এই রাধেশ্যামের ঘরে শ্রী ফিরবেই।
হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ।।