থ্রি সিক্রেটস
“কি রে কিছুই তো দেখে গেলি না। সবই কি বানিয়ে লিখবি?”
‘অত চাপ নিয় না বাবা। সব ঠিক হয়ে যাবে।‘
“কিছু Essay তো দেখে যেতে পারতিস। কাছাকাছির মধ্যে টপিকটা আসলে তোর লিখতে সুবিধা হতো।“
‘কিছু Essay দেখেছি। সেরকম টপিক আসলে ভালো। না হলেও কোনও চাপ নেই। স্টোরি রাইটিং অপশন আছে তো।‘
“স্টোরি! “ আমি হায় হায় করে উঠলাম। ছোট্টু যদি স্টোরি লেখে, তাও আবার পরীক্ষার খাতায়, তাহলে সেই গল্পের গরু যে ঘাস ছেড়ে পরীক্ষকের মাথা চিবিয়ে খাবে, সে নিয়ে আমি নিশ্চিত। কিন্তু ছোট্টুর আজকের ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ পরীক্ষা নিয়ে নিশ্চিত বা হতে পারছি কোথায়।
আমার পাশে ছোট্টু বসে। যশোর রোড ধরে ড্রাইভ করছি। অফিস টাইম বলে রাস্তায় ট্রাফিকের বেশ চাপ। তবু একহাত স্টিয়ারিং এ। আর এক হাত ছোট্টুর কাঁধে বরাভয়ের মতো রেখেছি। ICSE পরীক্ষা। এই প্রথম বোর্ডের এক্সাম দিচ্ছে আমার ছোট ছেলে। এতদিন স্কুলের টিচাররা ক্ষমা ঘেন্না করে ব্যাপারটা ম্যানেজ করে দিয়েছে। কিন্তু এবার তো বাইরের টিচার। কি যে হবে ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে গেল ওদের ছোটবেলার কথা। আবার ধরলাম ছোট্টুকে।
“গল্প লেখা তো বেশ শক্ত রে। যে থিমের উপর লিখতে হবে সেই থিমটাকে আগে বুঝতে হবে। তারপর সেই থিমটা অনুযায়ী ঘটনা, চরিত্র সব ভাবতে হবে। তারপর আস্তে আস্তে ঘটনার সুতো ছাড়তে ছাড়তে ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছাতে হবে। তারপর…”
‘ও নিয়ে তুমি ভেবো না। ওসব আমি অনেক লিখেছি আগের পরীক্ষা গুলোই।‘ ছোট্টু আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠে।
“আরে তোকে তো আমি চিনি। গল্প কপি করতে তুই ওস্তাদ। কিন্তু নতুন জিনিস বানানো…”
আবার আমাকে থামিয়ে দিয়ে হো হো করে হেসে ওঠে ছোট্টু।
“হাসিস না ছোট্টু। ছোটবেলায় তোদের দুজনকে নিয়ে যখন গল্প গল্প খেলতাম তখন তোর দাদা খুব রেগে যেতো তোর উপর। কারণ দাদা বানিয়ে যে গল্পই বলুক না কেন তুই নতুন কিছু দিয়ে শুরু করে ঠিক দাদার গল্পে ঢুকে পড়তিস। ওই সেই গরুর রচনার মতো। শ্মশানের রচনায়ও তুই গরুকে শ্মশানের ভিতরে ঢুকিয়ে ঘাস খাওয়াতিস।“
‘আরে বাবা। তুমি এত চিন্তা করছ কেন? এখানে তো আর দাদা নেই। যা করার আমি একাই করবো।‘ আমাকে আশ্বস্ত করার ঢঙে বলল ছোট্টু।
ভাবতে ভাবতে খেয়ালই করিনি কখন ওদের স্কুলে পৌঁছে গেছি। ছোট্টুকে নামিয়ে দিয়ে আমি চলে আসলাম। তারপর জীবনের প্রাত্যহিক ব্যস্ততায় দু তিন ঘন্টা হু হু করে কেটে গেল। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ছোট্টুকে আবার রিসিভ করে বাড়ি ফিরছি। একটু চুপ চাপই ছিলাম। পরীক্ষা কেমন হয়েছে জিজ্ঞাসা করছি না দেখে ছোট্টু নিজেই শুরু করলো।
‘তুমি কি এখনো চাপে আছো?’
“না না চাপের কি আছে। যা হওয়ার তো হয়েই গেছে। একবার পরীক্ষা হয়ে গেলে আমি আর চাপের মধ্যে থাকি না। তোকে তো সে কথা আগেই বলেছি।“
মুখে বললে কি হবে। আমি যে ওর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছি সেটা ছোট্টু বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছে। তাই আবার মুখ খুলল ও।
‘সে তুমি মুখে যাই বলো, তোমার চাপ কাটানোর জন্যই বলছি, পরীক্ষা কিন্তু আমি ভালোই দিয়েছি।‘
“হুমম। ভালো হলেই ভালো। তবে ভালো কি খারাপ সেটা Essay টা কেমন লিখেছিস সেটা দেখলেই বোঝা যাবে।“
‘আমি তো সেই জন্যই বলছি পরীক্ষা আমার বেশ ভালোই হয়েছে।‘
এবার আমার অবাক হবার পালা। ছোট্টু Essay টা ভালো লিখেছে বলাই আমি একটু নড়ে চড়ে বসলাম।
“তো কি Essay লিখলি?”
ছোট্টুর মুখে দুষ্টু মিষ্টি হাসি খেলে গেল। আমার দিকে একবার তাকিয়েই আকাশের দিকে গভীর মনোযোগে কি যেন দেখতে লাগলো। আমি যে একটা প্রশ্ন করেছি তার বিন্দু মাত্র প্রভাব তার উপর নেই। বুঝলাম বাবার কৌতুহলের পরীক্ষা নিচ্ছে তার ছোট ছেলে। তাই ছদ্ম রাগে আদর করে ছোট্টুর জুলফি টা ধরে টানতেই হাসতে হাসতে ও বলল
‘Essay নয় বাবা, Essay নয়।‘
“তাহলে?”
‘স্টোরি লিখলাম।‘
“স্টোরি! ?” আঁতকে উঠলাম আমি।
‘হ্যা বাবা স্টোরি। ‘
যে আশঙ্কাটা করছিলাম সেটাই সত্যি হয়েছে দেখছি। আর ভেবে লাভ নেই। হাল প্রায় ছেড়েই দিয়ে ছিলাম কিন্তু এয়ারপোর্টের সিগন্যালে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হচ্ছে দেখে স্ট্যান্ডটা চেঞ্জ করলাম।
“আচ্ছা বেশ বেশ। গল্প যখন লিখেই এসেছিস তো শুনি সে গল্পের কাহিনী। কি ছিল গল্পের থিম?”
‘গল্পের থিম ছিল “ দ্য সিক্রেট “।‘
“ওকে। কাহিনীর স্থান, কাল, পাত্র?”
‘এই সময়েরই গল্প। তবে প্লেসটা হলো বার্সেলোনার আউট স্কার্ট। আর মেইন ক্যারেকটার হলো অ্যারোন ও গ্যারুন।‘
বার্সেলোনা!! অ্যারোন! গ্যারুন! আমি আঁতকে উঠলাম। বলে কি ছোকরা। কোলকাতা থেকে একেবারে ক্যাটালোনিয়া! বাংলা বাদ দিয়ে একেবারে স্পেন! বেশ বুঝতে পারছি ছোট্টু কিছু একটা ঘোঁট নিশ্চয়ই পাকিয়েছে। এমনি তে আমার ছোট ছেলে ফুটবল পাগল। নেমারের একেবারে ডাই হার্ড ফ্যান। নেমার আগে বার্সেলোনা তে খেলতো। মেসির পাশে। এখন পিএসজি, ফ্রান্সে খেলে। মেসি আবার চাইছে ওকে বার্সেলোনা তে নিয়ে আসতে। কিন্তু তাই বলে ছোট্টু পরীক্ষার খাতায় একেবারে লোকেশন বার্সেলোনা করে দিলো! তার উপর আবার ওই সব ইনটারন্যাশানাল নাম- অ্যারোন, গ্যারুন। মাথাটা জট পাকিয়ে যাচ্ছে। গাড়িটা একি স্পীডে চললেও মনের ভুলে বেশ কয়েকবার গিয়ার চেঞ্জ করে ফেললাম।
‘ওহো। তুমি আগে শুনেই দেখো না।‘ ছোট্টু আমার মনের অবস্থা আন্দাজ করে হালকা একটা টোকায় বলটা বাড়ালো।
“বেশ বেশ। বলতে থাক।“ আমি কৌতুহলী হয়ে বলটা আবার ব্যাক পাস করলাম। বেশ বুঝতে পারছি গোলটা আমি খাবোই।
ছোট্টু গল্পের গাড়ি চালিয়ে দিলো –
‘ অ্যারোনের খুব রাগ তার বাবা মায়ের উপর।
বছর দুয়েক আগে যখন গ্রান্ডপা মারা গেলেন তখন কিছুতেই বাবা মা তাকে গ্রান্ডপা কে শেষ দেখার জন্য বার্সেলোনার আউট স্কার্টে গ্রান্ডপার বিশাল খামার বাড়িতে নিয়ে গেলেন না। কারণ তখন অ্যারোনের টেনথ্ স্ট্যান্ডার্ডের বোর্ড এক্সাম চলছিল।
সেই কবে ছোটবেলায় অ্যারোনের যখন চার পাঁচ বছর বয়স তখন ও গ্রান্ডপার কাছে গেছিল।খুব ভালোবাসতো গ্রান্ডপা ওকে। আদর করে ওকে একটা পুতুল দিয়েছিল ওর সাথে সবসময় খেলার জন্য। পুতুলটার নাম গ্যারুন। খুব ভাব হয়েছিল গ্যারুনের সাথে। গ্যারুনের মধ্যে কিছু একটা ছিল যেটা ওকে ম্যাগনেটের মতো টানতো। কিন্তু সেটা যে কি সেটা ও এখনো বুঝতে পারেনি। তাই এবার টুয়েলভথ্ স্ট্যান্ডার্ডের বোর্ড এক্সাম শেষ হতেই ও দাবি করলো যে এবার ও একাই গ্রান্ডপার খামার বাড়িতে যাবে।‘
“ এই দাঁড়া দাঁড়া। তুই তো এবার ICSE দিচ্ছিস। তা হঠাৎ নিজের বয়সী কাউকে না বেছে দু বছরের বড়ো দাদার বয়সী কাউকে বাছলি কেন?” গল্প লেখার সময় ছোট্টুর মনে ঠিক কি চলছিল তা বোঝার জন্য ওকে একটু থামালাম।
ছোট্টু কিঞ্চিত বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলো –
‘ ওহো বাবা। বোঝার চেষ্টা করো। ১৮+ না হলে একা একা অ্যারোন কে বাড়ির বাইরে থাকার অনুমতি দিতো না ওঁর বাবা মা।‘
হুমম্। ছেলে বার্সেলোনার প্রেক্ষাপটে লিখলে কি হবে ভিতরে বাঙালী ঐতিহ্য কাজ করছে। আবার গল্পের প্রয়োজনে বয়সটা বাড়িয়ে ১৮+ করে নিয়েছে যাতে সোশ্যালি অ্যাকস্পেটবল হয়!
“ বাঃ। সব দিকে নজর রেখেছিস তো!” আমি একটু পিঠ চাপড়ানি দিতেই ছোট্টু আবার গড় গড় করে বলতে শুরু করলো।
‘ অ্যারোন একাই যেতে চাই খামার বাড়িতে। কারণ খামারবাড়িতে এখন কেয়ারটেকার ছাড়া কেউ থাকে না। অতো বড়ো খামারবাড়ি এখন কিছুটা ঘোস্ট হাউসের চেহারা নিয়েছে। তাই পুরো থ্রিলটা পেতে গেলে ওকে একাই যেতে হবে ওখানে। তাছাড়া আরও একটা আকর্ষণ হলো গ্যারুন। সেই পুতুলটা। গ্রান্ডপা লাতিন আমেরিকা থেকে এনেছিল ওকে। যে সবসময় অ্যারোনের সাথে থাকতো, ওর চার পাঁচ বছর বয়সে খামার বাড়ি থাকার সময়। গ্রান্ডপা প্রথমে ওকে পুতুলটা দিতে চান নি কেন কি এক অজ্ঞাত কারণে। কিন্তু যখন দেখলেন যে তাঁর আদরের নাতি খুব বোর হচ্ছে তখন দিয়ে দেন গ্যারুন কে ওর কাছে।‘ এই অবধি বলে ছোট্টু একটু জল চেয়ে নিয়ে খেলো।
“ তারপর?” আমি আমার কৌতুহলটা না চেপে আলতো করে ভাসিয়ে দিলাম।
‘ তারপর অ্যারোনের সর্ব ক্ষণের সঙ্গী হয়ে উঠলো গ্যারুন। খামারে ছোটা ছুটি খেলার সময় গ্যারুন কে একটা বেঞ্চে বসিয়ে দিতো অ্যারোন। তারপর চকিতে একটা গোলাপ ফুলের বাগানের চারিদিকে চরকি পাক দিয়ে এসে কোমরে দুহাত দিয়ে দাঁড়িয়ে গ্যারুনকে বলতো- দেখলে আমি কেমন জোরে ছুটতে পারি! হাওয়ার চেয়েও জোরে। বলেই হা হা করে দুলে দুলে হেসে উঠতো অ্যারোন। সেই হাসি হাওয়ায় ভর দিয়ে গাছের পাতায় পাতায়, ঘাসের ডগায় ডগায় ছুঁয়ে খামার বাড়িটার চারপাশে ঘুরপাক খেয়ে আবার চলে আসতো ওদের কাছে। সেই হাওয়ায় গ্যারুনও যেন একটু দুলে উঠতো।
কখনো আন মনে গান গেয়ে উঠতো অ্যারোন। কান্ট্রি সং। ওর গ্রান্ডপা শিখিয়েছিল। ভারী মজাদার সেই গান। গাছের পাখিরাও চুপটি করে শুনতো সেই গান। তারপরে গান শেষ হলেই কিচিরমিচির করে আনন্দে উড়ে এক ডাল থেকে আর এক ডালে বসতো। রঙ বেরঙের প্রজাপতি গুলোও চলে আসতো গান শুনতে। গ্যারুনের হাতে বসে এমন ভাবে পাখা দোলাতো যে মনে হতো গ্যারুনের হাতটা কাঁপছে। চোখ দুটো মনে হতো খুশীতে হাসছে। অদ্ভুত একটা আনন্দ হতো অ্যারোনের গ্যারুনের এই খুশি খুশি ভাবটা দেখে। মন খুলে গল্প বলতো ওর সাথে। কতো কি গল্প। যা যা গ্রান্ডপা ওকে শুনিয়েছে সব ও শোনাতো গ্যারুনকে। গ্যারুন সব শুনতো। পড়ন্ত বেলার সূর্যের রং বাহারি আলোর সাথে সাথে গ্যারুনেরও যেন মুখের রঙ চেঞ্জ হয়ে যেতো। ও যেন সব বুঝত গল্পের কথা।
রাতে ঘুমানোর সময়ও ও আর গ্যারুন একসাথে ঘুমাতো। পাশাপাশি বালিশ। ও গ্যারুনকে জড়িয়ে ধরে শুতো। কতো রাতে অ্যারোনের মনে হয়েছে যে গ্যারুনও ওকে জড়িয়ে ধরে আছে। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে ও উঠে দেখতো গ্যারুন ওর দিকে পাশ ফিরে শুয়ে আছে।
এমন সব মনে হতো অ্যারোনের তখন ছোটবেলায়। এখন অবশ্য ভাবলে হাসিই পাই ওর। কিন্তু শেষ দিনের অভিজ্ঞতাটা! সেটা ভুলবে কি করে অ্যারোন। সেটা যে আজও ও ওর মনের গভীর কোনে লুকিয়ে রেখেছে। কাউকে বলেনি। আজ আবার মনে পড়ল।
ছুটির দিনগুলো ফুরিয়ে আসছিল দ্রুত। খামার বাড়ি থেকে সামার ভ্যাকেশন কাটিয়ে ফিরতে হবে এবার বার্সেলোনার নিজেদের বাড়িতে। বাবা মা বারবার তাগাদা দিচ্ছে। গ্রান্ডপাও চাইছে এবার অ্যারোন ফিরে যাক। শুধু গ্যারুন কিছুতেই যেন ছাড়তে চাইছে না। ও যেন মনে মনে বলছে যেয়ো না অ্যারোন। যেয়ো না। তুমি চলে গেলে আমি…। শেষটা যে কি বলতে চেয়েছিল গ্যারুন এতো বড় হয়েও বুঝতে পারেনি অ্যারোন। শুধু ফিরে আসার সময় ও গ্যারুনকে সাথে নিয়ে যাওয়ার বায়না করাই গ্রান্ডপা ভীষণ রেগে গেছিলেন। এক ঝটকায় গ্যারুনকে ওর কোল থেকে কেড়ে নিয়ে জলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন ওর দিকে। আর ও স্পষ্ট দেখেছিল গ্যারুনের চোখটা চিকচিক করে উঠেছিল কান্নায়।
আজ সেই দিন। অ্যারোন আজ গ্রান্ডপার খামার বাড়িতে যাচ্ছে। ওকে আজ খুঁজে বের করতেই হবে গ্যারুনকে। খুঁজে বের করবেই গ্রান্ডপার ও রকম আচরণের রহস্য।‘
আবার একবার বোতল থেকে জল খেলো ছোট্টু। গল্পের আবহে আমিও কেমন বমকে গেছি। এটা ছোট্টু লিখেছে? মৌলিক? একটা সন্দেহের তিরতিরে হাওয়া আনন্দ টাকে ঠিক খেলতে দিচ্ছে না। তবু ছোট্টুকে বাহবাই দিলাম-
“বাঃ। সুন্দর হচ্ছে। তারপর?”
ছোট্টু আবার বলে চলল-
‘খুব তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেল অ্যারোন খামার বাড়িতে। কেয়ারটেকার থাকলেও অযত্নে কেমন একটা বিবর্ণ গা ছমছমে ভৌতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে সারা বাড়িটা জুড়ে। সেই গোলাপের বাগান, সেই গাছগুলো, সেই সবুজ ঘাস, সেই কালারফুল প্রজাপতিগুলো সব একই আছে। শুধু কি যেন একটা নেই। নেই, নেই, নেই। সেই ছুটে বেড়ানো ছোট্ট তুমিটাই তো নেই অ্যারোনদাদা। পাখিগুলো উড়তে উড়তে যেন বলে গেল।
আর একজনও তো নেই। ভাবলো অ্যারোন। তার প্রাণের বন্ধু গ্যারুনও তো নেই। ভাবতে ভাবতে মনটা ভার হয়ে গেল অ্যারোনের। তাই একটু খামার বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে ছোটবেলার অন্য বন্ধুদের সাথে দেখা করে আসলো অ্যারোন। গল্পে মজায় কোথা থেকে যেন সকাল পেরিয়ে দুপুরে পৌঁছে গেল সময়। খুব খিদে পেয়েছিল অ্যারোনের। তাড়াতাড়ি ফিরে এসে কেয়ারটেকার আঙ্কেলের বানানো পাস্তা, জ্যামন সের্রানো, ইবেরিয়ান হালিবুট আর স্যালাড সহ টর্টেলো স্প্যানোলা ভাজা খাওয়ার পর চোখটা আর খুলে রাখতে পারেনি।
যখন ঘুম ভাঙল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চারিদিকটা নিঝুম। কেয়ারটেকার আঙ্কেল বিভিন্ন জায়গায় একটা করে বড় বড় মোমবাতি জ্বালিয়ে গেছেন। মোমবাতির স্বল্প আলোতে চারিদিকটায় কেমন একটা আবছায়া তৈরি হয়েছে। বাইরের একটানা ঝিঁঝির আওয়াজকে থামিয়ে দিয়ে মাঝে মাঝে একটা দমকা বাতাস কুঠিবাড়িটার কোনে কোনে ঘুরপাক খেয়ে একটা অদ্ভুত ফিসফিসানির আওয়াজ তুলে হারিয়ে যাচ্ছে।
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল অ্যারোন। একটু কি গা ছমছম করছে এতো বড় বাড়িটাই একা থাকার জন্য। এমনটাই তো চেয়েছিল অ্যারোন। থ্রিলটা উপভোগ করতে চেয়েছিল। একটা মোমবাতি হাতে নিয়ে বারান্দায় বেরোতেই একটা দমকা হাওয়া এসে হাতের মোমবাতি টাকে নিভিয়ে দিলো। চারিদিক টা এতো অন্ধকার লাগছে কেন। অ্যারোন কি করবে বুঝতে না পেরে চেঁচিয়ে আঙ্কলকে ডাকতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে সিঁড়ির দিকে একটা মোমবাতি যেন জ্বলে উঠল। অদ্ভুত। ওখানে তো কোন মোমবাতি জ্বলছিল না। তাহলে? ভয়ের একটা ঠাণ্ডা স্রোত শিরদাঁড়া দিয়ে নামতে থাকল অ্যারোনের। তবু একটা অদম্য কৌতুহল অ্যারোনকে ঠেলে নিয়ে গেল সিঁড়িটার দিকে।
সিঁড়ি টা গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে একটা অংশ দোতালার দিকে চলে গেছে। আর একটা অংশ অল্প নীচে নেমে হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে একটা দরজার সামনে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। কি করবে মন স্থির করার আগেই অ্যারোন চমকে উঠে দেখল সিঁড়ির নীচের অংশে দরজাটা দড়াম্ করে খুলে গিয়ে আর একটা মোমবাতি ওখানে জ্বলে উঠল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওদিকে এগিয়ে চললো অ্যারোন। দরজাটা ক্রশ করার পরই সিঁড়িটা আবার ঘুরে ঘুরে নীচে নামতে শুরু করেছে। একটা করে বাঁক আসছে আর একটা করে মোমবাতি জ্বলে উঠছে। বেশ কিছুটা নামার পর বাইরের ঝিঁঝির আওয়াজটা থেমে গিয়ে অদ্ভুত একটা নিস্তব্ধতা। তারপরে যেটা হলো সেটার জন্য প্রস্তুত ছিল না অ্যারোন।
একটা স্পষ্ট পায়ের আওয়াজ। ছোট বাচ্চাদের হাটার মতো। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছে। আর চুম্বকের মতো টানছে অ্যারোনকে। প্রতি বাঁকে মোমবাতিরাও জ্বলতে থাকছে। দেখতে দেখতে অ্যারোন একটা অন্ধকার কুঠুরির মধ্যে উপস্থিত হলো। এমন ঘর তো আগে কখনো দেখেনি অ্যারোন। এটা কি তবে গ্রান্ডপার গুপ্তকক্ষ। পায়ের শব্দটাও তো আর পাওয়া যাচ্ছে না। তবে কি সে এখানেই আছে। আশেপাশে। একটা বাতাস যেন খিলখিল করে হেসে উঠলো ওর চারপাশে। চেঁচিয়ে উঠতে গিয়ে অ্যারোন দেখলো শুকিয়ে ওর গলা কাঠ হয়ে গেছে। আর তারপরেই একটা ভারী পায়ের শব্দ ধুপধাপ করে এগিয়ে আসতে লাগলো। ছোট পায়ের শব্দটাও আবার শোনা যাচ্ছে। ত্রস্ত পায়ে সেটা যেন কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছে। তারপরেই একটা বাক্স বন্ধ হওয়ার শব্দ। তারপর সব চুপচাপ। শুধু বুকের ধুকপুকানি আওয়াজটা তীব্র হয়ে নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিচ্ছে। ভারী পায়ের শব্দটাও আর শোনা যাচ্ছে না। অন্ধকারটা আরও ভারী হয়ে আসল চারিদিক থেকে । যেন গলা চেপে ধরতে চাইলো অ্যারোনকে। অ্যারোনের পা দুটো কে যেন শক্ত করে বেঁধে দিয়েছে । একটুও নড়তে পারছে না। ভয়ে চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল অ্যারোন। এমন সময় হঠাৎ করে আর একটা মোমবাতি জ্বলে উঠলো ঘরের মধ্যে। অল্প আবছায়া তৈরি হলো ঘরটার মধ্যে। অল্প পরিসরের একটা পুরনো বাঙ্কার। তারমধ্যে একটা স্বর্ণখচিত বেশ কারুকাজ করা ছোট কফিনের মতো দেখতে একটা বাক্স। আর তার উপরই জ্বলছে মোমবাতিটা। কে যেন চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে গেল অ্যারোনকে ওই বাক্সটার কাছে। বাক্সটার গায়ে হাত দিতেই একটা শতাব্দী প্রাচীন ঠান্ডার স্রোত হাত বেয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল। মুহূর্তে হাতটাকে টেনে সরিয়ে নিতে চাইলো অ্যারোন। কিন্তু কে যেন জোর করে টেনে ধরেছে হাতটা। তারপর ওর হাতটা দিয়ে মোমবাতিটা সরিয়ে কে যেন বাক্সটা খুলে ফেললো এক ঝটকায়। বাক্সটা খুলতেই যা দেখলো অ্যারোন তাকে অবিশ্বাস্য বললে কম বলা হয়। একটা হাফ ডিকম্পোসড বডি শুয়ে আছে বাক্সের ভিতর যে অ্যারোনের খুব খুব চেনা। সে আর কেউ নয় গ্যারুন। এমন সময় মোমবাতি টা এক দমকা হাওয়ায় নিভে গেল। দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল বাক্সের দরজা। আর একটা দমবন্ধ করা ভারী বুড়ো মানুষের গায়ের গন্ধ ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকলো অ্যারোনের দিকে।‘
গল্প শেষ। শুনতে শুনতে কখন বাড়ি চলে এসেছি বুঝতেই পারিনি। ছোট্টুর দাদা সব শুনে বলল –
‘ উফফ্ বাবা! ভাই আবার গোল দিয়ে দিলো।‘
“ কেন রে? কি হয়েছে?”
‘ আর কি। কিছু দিন আগে আমি আমাদের ক্লাস টুয়েলভ এর সিলেবাসে সত্যজিত রায়ের The Fritz নামে যে শর্ট স্টোরি টা আছে সেটা পড়ছিলাম। ছোট্টু পাশে বসে শুনছিল….’
সত্যজিত রায়ের সেই শর্ট স্টোরির স্থান রাজস্থানের বুন্দী গ্রামে। মুখ্য চরিত্র জয়ন্ত ও তার বন্ধু শঙ্কর। আর জয়ন্তর ছোটবেলার সুইস পুতুল Fritz। সেই গল্প টাকে অনুসরণ করে, গ্রান্ডপার মতো একজন রহস্যময় চরিত্রের আমদানি করে, শেষ পর্বটা সম্পূর্ণ নতুন ভাবে তৈরী করে, তদুপরি নিজের মতো একেবারে বার্সেলোনায় ফেলে গল্পটা প্রায় পুরোটা চেঞ্জ করে ছোট্টু আমাকে একেবারে তাক লাগিয়ে চলে গেল। লাঞ্চে যাওয়ার আগে চোখ নাচিয়ে বলে গেল –
‘কি! গোল দিলো তো বার্সেলোনা! ‘
0 Comments