ছাতাবাবু

নিলয় বরণ সোম on

chhatababu
মূল গল্প : The Umbrella Man 
লেখক: Roald Dahl
অনুবাদ : নিলয় বরণ সোম
[ পূর্বকথাঃ এই গল্পটি লেখকের  More Tales of the Unexpected গ্রন্থ থেকে নেওয়া । এই অনুবাদকর্মটি নেহাতই মানুষের , বিশেষত ছোটদের   মনোরঞ্জনের  জন্য এবং এর কোন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নেই , এবং ভবিষ্যতেও  কোন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে লেখক সজ্ঞানে এটি ব্যবহার করবেন না বা ব্যবহার করার অনুমতি দেবেন না , সুতরাং এটি  আমেরিকা যুক্তরাস্ট্র কপিরাইট আইনে উল্লেখিত  ‘Fair Use’ এর   মধ্যে পড়ে ও  কপিরাইট  লঙ্ঘনের  কোন প্রশ্ন এখানে নেই।  আক্ষরিক অনুবাদ না করলেও, গল্পটির বিদেশী আবহ বজায় রাখা হয়েছে     – বিনীত অনুবাদক। ]

গতকাল সন্ধ্যাবেলা  আমার আর মায়ের সঙ্গে যে মজার ঘটনাটা ঘটেছে সেটাই বলতে বসেছি । আমার বয়স মাত্র বারো হলেও লম্বায় প্রায় মায়ের মত ,দূর থেকে আমাদের তাই লোকে মা মেয়ে না ভেবে দুই বোন ভাবে । 

কাল বিকেলে মা আমাকে এক ডেন্টিস্টের কাছে নিয়ে গেছিল। যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তারবাবু বলে দিলেন, আমার একটা  দাঁতে ক্যাভিটি আছে । পোকায় খাওয়া দাঁতটা উনি ফিল আপ করে দিলেন, ভাগ্য ভাল , খুব ব্যাথা লাগে নি আমার । এরপর মায়ে  বেটিতে   মিলে একটা ক্যাফেতে গেলাম, আমি নিলাম একটা ব্যানানা স্প্লিট আর মা নিল শুধু কফি । ক্যাফে থেকে    বেরোতে বেরোতে         ছ’টা  বেজে গেল । 

রাস্তায় বেরিয়ে দেখি বৃষ্টি পড়ছে । মা বলল, ” একটা ট্যাক্সি নিতেই হবে !” ডেন্টিস্টের কাছে তো আর আমরা খুব সেজেগুজে করে যাই নি, সাধারণ কোট আর হ্যাট পরেই গেছিলাম ,  জবরজং পোশাক গায়ে না থাকলেও  বৃষ্টিতে  চলতে  কিন্তু অসুবিধেই হচ্ছিল । 

“চলো, আমরা ক্যাফেতে ফিরে যাই , বৃষ্টি থামলে বেরোন যাবে । আমার আসলে ধান্দা ছিল আরেকটা ব্যানানা স্লিট সাঁটানো , বড্ড ভাল ছিল ওটা । “

মায়ের কোন উৎসাহ দেখলাম না । মা বলল , ” এই বৃষ্টি সহজে  থামার নয় । যত তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছতে পারি, তত ভাল । “বৃষ্টির মধ্যে আমরা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সির দিকে চোখ রাখছিলাম । যাচ্ছিলও ক’টা ,কিন্তু সব যাত্রীবোঝাই । মা  আস্তে করে শুধু বলল , ” আমাদের যদি গাড়ি আর ড্রাইভার থাকত , তবে এই অসুবিধায় পড়তে হত না । 

ঠিক সেই সময় আমাদের সামনে এক বুড়ো ভদ্রলোক এসে হাজির । দেখতে ছোটখাট ভদ্রলোকটির বয়স প্রায় সত্তর তো হবেই । মাথার টুপিটা একটু খুলে মায়ের উদ্দেশ্যে উনি বললেন , ” এক্সকুইজ মি ,আপনার থেকে খুব সামান্য একটা সাহায্য চাইছি, আশা করি নিরাশ করবেন না !”

 বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখিয়ে মা বলল, ” বলুন !”

” যা বললাম আপনার থেকে একটা ছোট সাহায্য চাই, এইটুকু সাহায্য !”

দেখলাম, মা ভদ্রলোকের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমার মায়ের এমনিতে একটু সন্দেহ বাতিক আছে । দুটো জিনিসের উপর মায়ের সন্দেহ সবথেকে বেশি এক হচ্ছে অচেনা লোক   আর দুই হচ্ছে ডিম্   সেদ্ধ   । সেদ্ধ ডিমের ওপরটা ছুরি দিয়ে কাটার পর  মাকে   দেখি চামচ দিয়ে একটু খোঁচাতে , যেন   ভিতরে ছুঁচো বা ইঁদুর আছে কিনা দেখছে !

আর অচেনা লোকের ব্যাপারে মায়ের তো একটা বিখ্যাত থিওরি আছে , ” অচেনা লোক কে              বেশি ভদ্রতা   করতে   দেখলে তাকে সন্দেহ করবি আরো বেশি !” এই বেঁটেখাটো বুড়ো লোকটি কিন্তু খুব ভদ্র । কথা বার্তায় মার্জিত , পোশাকও  ফিটফাট  । পাক্কা ভদ্রলোক বলা যায় ওঁকে , বিশেষ করে ওঁর জুতোর দিকে তাকিয়ে আমার এই কোথায় মনে হল  । বলতে গেলে  এই     থিওরিও     আমার মায়ের কল্যানে জানা ,” কোনো পুরুষ ভদ্রলোক কিনা বোঝা যায় তার জুতোর দিকে তাকালে !”

এই ভদ্রলোক এক জোড়া সুন্দর বাদামী জুতো  পরেছিলেন ।  

  এবার উনি আবার শুরু করলেন , “ ব্যাপারটা হল, আমি একটা ঝামেলায় পড়ে গেছি, তাই একটু সাহায্য চাই । আপনার কাছে সেটা কিছুই না কিন্তু আমার কাছেবিরাট    কিছু । জানেনই তো, আমাদের মত    বয়সের  অর্ধেক বুড়ো মানুষরা ভুলোমনা আর এই ভুলো মনের জন্যই আজকে বিপত্তি । “

দেখলাম ,মা   মাথা উঁচু করে লোকটির দিকে একদৃষ্টে দেখছে । এই জিনিসটা কিন্তু খুব চাপের । মায়ের এই তাকানোর সামনে বাঘা বাঘা লোক ঘায়েল হয়ে যায়। একবার মায়ের এই দৃষ্টির সামনে আমাদের স্কুলের হেড মাস্টার  মশাইকে  ঘেমে  নেয়ে  একসা  হয়ে, তোতলাতে দেখেছি । কিন্তু ছাতি বুড়োর দেখলাম হেলদোল নেই । একটু হেসে   মাকে বললেন, “বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, রাস্তাঘাটে মহিলাদের থামিয়ে দুঃখের গল্প ফাঁদার লোক আমি নই । “

মা  জবাব দিল , ” সেটাই তো বাঞ্ছনীয় । “

মায়ের এই সোজা সাপ্টা কথায় আমার বেশ লজ্জা লজ্জা লাগছিল। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল মা কে বলি, “মা মনি , এই সুইট দাদু নিশ্চয়ই কোন ঝামেলায় পড়েছে , ওর সঙ্গে অভদ্র  হয়ো না প্লিজ । ” মনের কথা আমাকে মুখেই রয়ে গেল , কিছু   বলতে পারলাম না আমি । 

বুড়ো মানুষটা হাতের ছাতাটা এক হাত থেকে অন্য হাতে নিলেন,, “ এর আগে কখনো এমন ভুল হয়নি আমার । “

“কী ভুল হয়েছে আপনার ?”,মা বলল ।

 -“ওয়ালেট ফেলে এসেছি ।   নিশ্চয়ই   আমি আমার অন্য জ্যাকেটটার ভিতর এটাকে ঢুকিয়ে রেখেছি -পুরো ব্যাপারটা কেমন বোকা বোকা না ?”

মা বললো , “তাহলে ব্যাপারটা হচ্ছে আপনাকে কিছু পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে হবে, তাই তো ?”

ভদ্রলোক চেঁচিয়ে উঠলেন , : “ওহ না, এরকম দয়া ভিক্ষা যেন আমাকে জন্মেও না করতে হয় !”

মা এবার বলল, : “তাহলে আপনার চাই কী ? দেখুন, এরকম করে বৃষ্টিতে ভিজতে আমাদের একটুও ভাল লাগছে না,আমি জানি সেটা।  সেজন্যই আমি বলছি, আপনি আমার ছাতা নিন, আর একেবারেই নিয়ে নিন, কিন্তু তার জন্য,,”

-“কিন্তু তার জন্য কী ?”

– ” এর বদলে আপনি যদি আমাকে ট্যাক্সি করে বাড়ি ফেরার জন্য এক পাউড দেন,!”

মায়ের সন্দেহ  গেল না । “প্রথম থেকেই আপনার পকেট যদি ঢুঁ ঢুঁ ; করে, আপনি    এতদূর                                  এলেন কী করে ?”

উনি   জবাব দিলেন  ” আমি হেঁটে এলাম। প্রত্যেক দিন আমি হেঁটে হেঁটে  কোথায়  চলে যাই  আর ট্যাক্সি ডেকে  বাড়ি ফিরে আসি । “

-“তাহলে এখন  আপনি হেঁটে যাচ্ছেন না কেন ? “

-“পারলে তো ভালই  হত , কিন্তু এই বুড়ো বয়সে আমি আর সেটা পারবো না ।আজ অনেক হেঁটে ফেলেছি  “

মা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়াতে লাগলেন । বুঝতে পারলাম, মা একটু গলে গেছে। আর এসময় একটা ছাতা পাওয়া গেলে ব্যাপারটা মন্দ হয় না,এটাও মায়ের মাথায় খেলেছে । 

বুড়ো মানুষটি বললেন, ” দারুন কিন্তু ছাতাটা !”

-“লক্ষ্য করেছি,:” মায়ের সংক্ষিপ্ত জবাব । 

-” এটা কিন্তু সিল্ক “

-” দেখেছি সেটা “

-“তাহলে ম্যাডাম আপনি নেবেন না কেন? এটার দাম ছিল ২০পাউন্ড । কিন্তু এই মুহূর্তে  তার কোন গুরুত্ব আমার কাছে নেই , আমি শুধু বাড়ি ফিরতে চাই।”

দেখলাম মায়ের হাত বটুয়ার দড়ির দিকে যাচ্ছে  । আমি যে মাকে দেখছি এটা আবার মা টেরিয়ে টেরিয়ে লক্ষ্য করছিল । এবার আমি আমার স্পেশ্যাল চাউনিটা মাকে দিলাম । মনে মনে বললাম, ” দোহাই মা, এই বিপদে পড়া বুড়োটার বিপদের সুযোগটা নিও না, আর যাই করো !”আমি জানি , আমি কি বলছি মা ঠিক বুঝতে পেরেছে । মা একটু থিম আবার আমার দিকে তাকাল । 

বুড়ো ভদ্রলোককে মা বলল এবার, ” আমার মনে হয় আপনাকে এক পাউন্ড দিয়ে ওই ২০পাউন্ডের ছাতাটা নেওয়া ঠিক কাজ হবে । আপনাকে আমি ট্যাক্সি ভাড়ার টাকাটাই দিচ্ছি !”

এবার বুড়ো ভদ্রলোক চেঁচিয়ে উঠলেন , ” না না ,কিছুতেই না ম্যাডাম  ! আমার প্রাণ থাকতে আপনার থেকে এমনিতে টাকা নিতে আমি পারবো না । ছাতাটা নিয়ে  বৃষ্টি থেকে আপনি বাঁচুন, বাচ্চা মেয়েটিকেও বাঁচান !”

মা আমার দিকে তেরছা মত তাকিয়ে একটা বিজয়ী বিজয়ী ভাব দেখালেন । বাছা ভুল তোমার, উনিই ছাতা নেওয়ার জন্য জোরাজুরি  করছেন !

মা এবার বটুয়ার থেকে এক পাউন্ডের একটা নোট বের করল । ভদ্রলোক টাকাটা নিয়ে মায়ের হাতে ছাতাটা তুলে দিলেন । টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে , টুপিটা একটু তুললেন , একটু  ঝুঁকে  মাকে বললেন , “থ্যাংক ইউ , ম্যাডাম,”থ্যাংক ইউ !”

” এবার ছাতার নীচে চলে আয় । মা বলল, ” আমরা সত্যি লাকি । একটা সিল্কের ছাতা কেনার  সামর্থ্য নেই আমার  , দ্যাখ, সেটাও জুটে  গেলো!

” প্রথমে তুমি ওঁর সঙ্গে ওরকম ব্যবহার করছিলে কেন ?” -” আমি নিশ্চিত হতে চাইছিলাম লোকটা ঠগ কিনা । না রে , জেন্টলম্যান যাকে বলে,- ওঁকে    সাহায্য করতে পেরে ভালোই লাগছে । “

-“হ্যাঁ মা,  আমিও   একমত  । “

-“পাক্কা  ভদ্রলোক – পয়সাকড়িও আছে , না হলে সিল্কের ছাতা নিয়ে ঘুরত না । আমি অবাক হবে না যদি উনি নাইট গোছের  কেউ হন -স্যার হ্যারি গডসওয়ার্থ বা সেরকম একটা কিছু । “

-” হ্যাঁ মা “

মা লেকচার দিতে থাকেন , ” তোমার এটা একটা ভাল শিক্ষা হল ।  কাউকে  চটজলদি  বিচার করতে নেই , সময় নিয়ে তারপর তোমার  সিদ্ধান্ত নিও । তা হলে জীবনে আর ভুল করবে না । “

-“ওই দেখ ,উনি যাচ্ছেন,” আমি বললাম । 

-“কোথায় ?”

-” ওই দেখ , রাস্তা পার হচ্ছেন – বাব্বা, কী তাড়াহুড়াই  না করছেন !”

দুজনেই দেখলাম , ভদ্রলোক বেশ ট্রাফিক ডজ করে রাস্তা পারলেন, তারপর খুব তাড়াতাড়ি বাঁয়ে মোড় নিলেন । 

-“মা ভদ্রলোককে খুব টায়ার্ড তো লাগছে না !”

মা উত্তর করলেন না । 

-“মা, উনি ট্যাক্সি খুঁজছেন বলে তো মনে হচ্ছে না !” মা পাথরের  মত  দাঁড়িয়ে রাস্তার ওপারে নজর করছিল । এবার ওঁকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল । জোর কদমে ফুটপাথ দিয়ে অন্য পথচারীদেড় পাশ কাটিয়ে মার্চ করতে করতে চলেছেন । 

মায়ের মুখটা দেখলাম থমথমে । “কিছু একটা করতে চলেছেন উনি “-অবশেষে মা মুখ খুললো । 

-কী মা ?”

-” সে আমি কী জানি !” 

কিন্তু আমি সেটা বের করবোই-যায় আমার সাথে । “

আমার দুজনে রাস্তা পেরিয়ে বাঁয়ে মোড় নিলাম । 

-” তুমি ওঁকে দেখতে পাচ্ছ ?” 

-হ্যাঁ ,  ডানদিকে পরের গলিটাতে  গেল দেখছি   । “

কোনায় এসে আমরা আবার ডাইনে বাঁক  নিলাম । বুড়ো এবার আমাদের থেকে কুড়ি গজ মত এগিয়ে । ওঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাঁটতে আমাদের বেশ কষ্ট  হচ্ছিল । ততক্ষনে বৃষ্টির তোড় আরো বেড়ে গেছে আর দেখলাম বৃষ্টির ছাঁট ওঁর হ্যাট বেয়ে কাঁধের উপর পড়ছে , আর ওঁর ছাতা মাথায় নিয়ে আমরা দিব্যি শুকনো  মাথায় হাঁটছি । 

-“উনি যাচ্ছেনটা কোথায় ?”মা বললো ।  

আমি বললাম, “যদি  ঘাড়  ঘুরিয়ে উনি আমাদের দেখে ফেলেন !”

-“আমার বয়েই গেছে । উনি আমাদের মিথ্যা কথা বলেছেন -আমাদের বললেন. ক্লান্ত শরীরে উনি আর হাঁটতে পারছেন না !আর এখন আমাদের ঘাম ছুটিয়ে দিচ্ছেন ! ও একটা ঠগ, জোচ্চোর – মা উনি থেকে ‘ও ; তে নেমে গেল । 

-মা ,তারমানে উনি নাইট টাইট কিছু নন !”

-“চুপ করবি এবার ?”

পরের ক্রসিংয়ে বুড়ো আবার   ডান   দিক নিল , তারপর বাঁ , তারপর আবার ডান । 

_আমি হাল ছাড়ছি না !,মা জোরে জোরে বললো । 

-মা কিন্তু ওকে তো আর দেখছি না -কোথায় গেল !

ওই তো , ওই বাড়িটাতে ঢুকল দেখলাম ! মাই গুডনেস !ওটা একটা বার !”

আমিও দেখলাম, বড় বড় অক্ষরে নিয়ন আলোয় লেখা রয়েছে , “দ্য রেড লায়ন । “

– তুমি ভেতরে যাবে না তো মা , তাই না ?”

“না, বাইরে থেকে দেখব কিছুক্ষন । ” বারের সামনের দিকে বেশ বড় কাঁচের জানালা । ভেতরটা একটু ধোঁয়াটে হলেও আমরা মোটামুটি দেখতে পারছিলাম । 

বারের জানালার ধারে আমরা চুপচাপ ঠেসে দাঁড়িয়ে ছিলাম , আমি মায়ের গা ঘেঁষে । বৃষ্টির ফোঁটাগুলি ছাতার উপর শব্দ করে পড়ছিল । মা কে বললাম , ” দেখ , ওই যে, ওই !”

লোকভর্তি ঘরটা সিগারেটের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ছিল ,আর আমাদের   ছোটখাট  হিরো ঘরের ঠিক মাঝখানে  দাঁড়িয়ে   । ওঁর মাথায় এখন হ্যাট বা গায়ে কোট নেই , ভিড় ঠেলে উনি কাউন্টারের সামনে যাচ্ছেন । বারম্যানের সঙ্গে ওঁকে কথা বলতে  দেখা গেল, বেশ ঘনিষ্ঠভাবে । বারম্যান একটু ঘুরে এসে ওঁর হাতে সোনালী   তরল ভরা পানপাত্র ধরিয়ে দিল, উনি এক পাউন্ডের নোটটি কাউন্টারে দিলেন ।  

মা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, ” আমার এক পাউন্ড ! লোকটার  দম আছে বটে   !”

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ” গ্লাসে কী আছে ?”,

– ” হুইস্কি , নীট হুইস্কি , সোডা  ফোড়া   কিচ্ছু নেয় নি !  শুধু তাই না রে  , মনে হচ্ছে ট্রেবল হুইস্কি নিয়েছে !

-“সেটা আবার কি ?

-সাধারন মাপের তিন গুণ !”

ছোটখাট মানুষটি হুইস্কির গ্লাসটি ঠোঁটে   ছোঁয়ালেন , তারপর হাতে করে গ্লাসটি একটু তুলে ধরলেন, তারপর আরেকটু, তারপর আরেকটু , তারপর এক ঢোঁকে  সবটুকু   পানীয়   গলায় ঢেলে দিলেন !

আমি বললাম , ” খুব  দামী   ড্রিংক , না ?”

-“ব্যাপারটা যাচ্ছেতাই !এক পাউন্ড খরচ করে এমন জিনিস কিনল যেটা এক ঢোঁকে গলায় ঢুকে যায় ?

আমি বললাম, “কোথায় এক পাউন্ড, এটা কিনতে  ওর খরচ হয়েছে  একটা কুড়ি পাউন্ডের সিল্কের ছাতা !

মা বলল, : ঠিক তাই , লোকটা নিশ্চয়ই পাগল । 

ছোটখাট মানুষটি এখন খালি গ্লাসটা নিয়ে  দাঁড়িয়ে ছিল , তার ফর্সা   মুখটিতে   এক গভীর প্রশান্তি খেলা করছে । দেখলাম, জিভ বের করে উনি গোঁফটা  মুছে  নিলেন, মহার্ঘ্য পানীয়ের শেষ বিন্দুটুকু  যেন উপভোগ করছেন । 

বার কাউন্টার থেকে এবার উনি বেরিয়ে এলেন , ভিড় ঠেলে ওঁর হ্যাট আর কোট যেখানে রাখা আছে , সেদিকে গেলেন । মাথায় টুপি পরলেন , কোটটি   গায়ে   চড়ালেন । তারপর খুব  আস্তে, মাখনের উপর  ছুরি    চালানোর মত করে কত স্ট্যান্ডে ঝুলে থাকা একটি ভেজা সিল্কের ছাতা নিয়ে কেটে পড়লেন সেখান থেকে । 

– “দেখলি দেখলি লোকটা কী করল ?”

– সসসস – আমি ফিসফিস করে বললাম, , ” উনি বেরিয়ে আসছেন !”

 আমরা    ছাতা দিয়ে নিজেদের মুখ আড়াল করলাম, আর তার নীচ দিয়ে ওকে লক্ষ্য করতে থাকলাম।

এবার উনি বেরিয়ে এলেন । আমাদের দিকে না তাকিয়েই নতুন ছাতাটা মাথায় দিয়ে ঠিক যেদিক থেকে এসেছিলেন সেদিকে  হাটা  লাগালেন  । 

 মা বলল , ” এটাই তাহলে ওর খেলা ?”

 আমি বললাম, নীট !

 আমরা   ওর পিছু পিছু বড় রাস্তার ঠিক যে জায়গাটিতে আমাদের দেখা হয়েছিল, সেখানে গেলাম । কিছুক্ষন বাদেই দেখলাম, ওর নতুন ছাতাটিও হাতবদল হয়ে গেল, এক পাউন্ডের বিনিমযে । এবার অবশ্য ওর শিকার একজন  রোগা  লম্বা    সাধারণ চেহারার  লোক, যার  পরনে কোটও ছিল না, মাথায় হ্যাট ও না । বিনিময় কার্য সমাপন হবার পরেই দেখলাম আমাদের ছোটখাট মানুষটি রাস্তা পার হলেন এবং জনসমুদ্রে মিশে গেলেন । কিন্তু এবার উনি রওয়ানা দিলেন উল্টো দিকে । 

মা বললো, ” কী চালাক লোকটা ! একটা পাবে দুবার যায় না !” 

“আমি বললাম, ও তো রাত ভোর এই চালাতে পারবে !”মা   বললো, ” হ্যাঁ  , তবে দেখিস , ও নিশ্চয়ই  যীশুর কাছে কেবল বৃষ্টির দিনের জন্য  প্রার্থনা  করে !


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


নিলয় বরণ সোম

নিলয় বরণ সোমের জন্ম ১৯৬৫ সালে উত্তর পূর্ব ভারতের ত্রিপুরার সালেমায়। স্থায়ী বাসস্থান কলকাতায়। প্রাথমিক শিক্ষা পিতার কর্মস্থল ত্রিপুরার বিভিন্ন মফস্বলে,উচ্চতর শিক্ষা কলকাতার দীনবন্ধু এন্ড্রুজ কলেজ ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। ভারত সরকারের আয়কর বিভাগে ১৯৯০সাল থেকে কর্মরত। জীবিকাসূত্রে কলকাতা ছাড়াও চেন্নাই ও ডেপুটেশন সার্ভিসে আফ্রিকার দক্ষিণে বতসোয়ানায় কাজ করেছেন। লেখালেখি ছাড়া পড়াশুনা , আড্ডা, গান শোনা ও ভ্রমণে আগ্রহী। সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকও লেখকের পছন্দের জায়গা। শৈশবে লেখালেখি শুরু করলেও কলেজ জীবনে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে বঙ্গ সাহিত্য সমিতির সভানেত্রী , বাংলার অধ্যাপিকা প্রয়াত মৈত্রেয়ী সরকারের উৎসাহে ও অভিভাবকত্বে ছোট গল্প লেখা শুরু হয়। বর্তমানে রম্যরচনায় ব্যাপৃত, অনুবাদেও উৎসাহ আছে। ছাত্রজীবন ও পরবর্তীকালে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন ও বিভাগীয় সাময়িকী ও প্রবাসকালে পূজা সংকলনে লেখকের লেখা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, একটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে 'কলেজ স্ট্রিট পত্রিকায়, ২০০১ সালে। দীর্ঘ বিরতির পরে বিভিন্ন ফেসবুক গ্রূপে লেখালেখি ২০১৬-১৭ সালে শুরু । ২০১৯ সালে ফেসবুক গ্রূপ ' শনিবারের আসরের ' ২০১৯ সালের পূজা সংকলনে একটি রম্যারচনা প্রকাশ পায় । ওয়েবজিন 'সময়.ইন ' এর কয়েকটি সংখ্যায় লেখকের রম্য রচনা স্থান পেয়েছে। সৃজনাত্মক সাহিত্যের পাশাপাশি আয়কর আইন সংক্রান্ত বিষয়ে লেখক লেখালেখি করেন।২০১৩ সালে বিভাগের 'ট্যাক্সপেয়ার ইনফরমেশন সিরিজে' যুগ্মলেখক হিসেবে 'Royalty and Fees for Techn।cal Serv।ces' শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ পায়। ২০১৯ সাল থেকে বিভাগীয় ওয়েবজিন 'ট্যাক্সলোগ'-এ লেখকের লেখা প্রকাশিত হয়েছে।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।