মৌখিক ইতিহাস ও পুরাকথায় দক্ষিণ দিনাজপুর (পর্ব – ৫)
আজ পঞ্চম পর্বের মৌখিক ইতিহাস ও পুরাকথায় জেনে নেবো তপন থানার ভায়োরের মায়ের থান ও দিনাজপুরের জনপ্রিয় লোকদেবী চামুণ্ডা সম্পর্কে। মায়ের থানের গল্পগাথা ও নিম্নবর্গের মানুষদের (Subaltern People) দ্বারা পূজিত চামুণ্ডা কী ভাবে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করল তা দেখে নিই –
মায়ের থানঃ
তপন থানার ভিকাহারের পশ্চিমে ফকিরপাড়া থেকে একটু দূরে ভায়োরের মায়ের থান। অনেকে বলেন ভায়োর কালী। আবার কেউ কেউ বলেন ডাকাত কালী। এখানে একাদশ / দ্বাদশ শতকের একটি দশভুজার মূর্তি আছে। মূর্তিটি সম্পর্কে নানা কথা শোনা যায়। কেউ বলেন বেলে পাথরের তৈরী দশভূজা দুর্গা মূর্তি। আবার অনেকে বলেন ভৈরবের মূর্তি।
Iconographic Studies -এ এর ব্যাখ্যা মেলা দায়। গ্রামে গঞ্জে আজও অনেক দেবী মূর্তি দেব মূর্তি হিসেবে পূজিত হচ্ছেন। আবার উল্টোটাও হচ্ছে। মন্দির ও মূর্তি নিয়ে তিনটি লোকশ্রুতি আছে –
১. একটি জনশ্রুতি কালো পাহাড়ের আক্রমণে এই মন্দির ও মূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২. আর একটি প্রচলিত গল্পগাথা – ধাসন বিলের ওপারের গ্রাম শালগাঁও থেকে এই মন্দিরের দেবী রাতারাতি পোতাহারের এখানে উঠে আসেন।
৩. শোনা যায় – দেবী চৌধুরানী পুনর্ভবা নদী দিয়ে বাংলাদেশের দিকে যাওয়ার সময় এই জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং এই মন্দিরে পুজো দেন। তবে একথা ঠিক যে অখন্ড দিনাজপুর তথা বৃহত্তর উত্তরবঙ্গের সঙ্গে দেবী চৌধুরানীর নিবিড় যোগাযোগ ছিল।
এই ভাবেই মৌখিক ইতিহাস আঞ্চলিক ইতিহাসকে আঁকড়ে ধরে আছে।
চামুন্ডাঃ
দিনাজপুরের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে চন্ডী পূজোর বিভিন্ন পদ্ধতি। চণ্ডীর বিভিন্ন রূপ দেখা যায়। এরই এক রূপ চামুণ্ডা। চামুন্ডার নানা রূপ – ভীষণা, লোলজিহ্বা, ভয়প্রদা, রক্তচক্ষু। দিনাজপুরের লোকদেবী চামুণ্ডা দারু (কাঠ) নির্মিত। মোখার মধ্যেই চামুণ্ডার অবস্থান। সমগ্র দিনাজপুর
জুড়েই চামুণ্ডা পূজিত হয়। দিনাজপুর জেলায় বিভিন্ন অংশে বহু শতাব্দী ধরে প্রায় সকল শ্রেণীর হিন্দুদের পূজো পান যেসব দেব-দেবী, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চামুণ্ডা। দেবী শাস্ত্রীয় বলে এই পুজোয় সর্বক্ষেত্রে বর্ণহিন্দু মানুষেরা এগিয়ে আসেন এবং কুলীন ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা পৌরহিত্য করেন। তবে অঞ্চল ভেদে ব্যতিক্রম আছে।
দিনাজপুরে রয়েছে সপ্ত চণ্ডীর পীঠস্থান। জনশ্রুতি আছে চামুন্ডারা সাত বোন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিনাজপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে পূজিত হয়ে আসছেন। বাংলাদেশের নওগাঁ, মহাদেবপুর সহ অন্যান্য কয়েকটি স্থানে চামুণ্ডা পূজিত হন। বিভাজিত দিনাজপুরের ভাকলা, বটুন, মাধবপুর, কুশমন্ডি, পতিরাম, খাঁপুর, কৃষ্ণগড়, হিলি, শিবরামপুর, তিওর, গুটিন, বালুরঘাট সহ অন্যান্য কিছু জায়গায় চামুণ্ডা পূজিত হন। পুজো উপলক্ষে বলি হয়। কোথাও পায়রা উৎসর্গ করা হয়। লোকক্রীড়া হিসেবে জিভ ও বগল ফোঁড়ানো হয়। রামদা, কুড়ুল নিয়ে ভক্তরা নানা কসরত করে, সঙ্ সেজে নাচ করে। অনেক জায়গায় পুজো উপলক্ষে মেলা বসে। এক সময়ের পুন্ড্রবর্ধন, বরেন্দ্রভূমি তথা দেবকোটে চামুণ্ডা জাগ্রত লৌকিক দেবী হিসেবে পুজো পেতেন। সেই ধারা আজও আমাদের জীবন সংস্কৃতিতে জড়িয়ে আছে।
*চতুর্থ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
0 Comments