“মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান”: স্মরণে কাজী নজরুল ইসলাম
“আজও উজানের হাওয়া লাগেনি
মাঝির নৌকা পালে
আজও সমাজে রক্ত ঝরে
ধর্ম ধর্মের বেড়াজালে”।
উনিশ শতকে বাংলার দরবারে যে সমস্ত সাহিত্যিক বা মনীষীরা শুধু বাংলায় নয় সমগ্র বিশ্বজুড়ে সাহিত্যের আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি শুনিয়ে গেছেন সাম্য মৈত্রীর বাণী। হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মেলবন্ধনের সাঁকো তৈরি করেছিলেন। তাই তো তার কলমের আঁচড় দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল
“মোরা একই বৃন্তে দুইটি কুসুম হিন্দু মুসলমান”।
সময় আপন গতিতে বয়ে চলেছে, কিন্তু আজও হয়নি মানসিক পরিবর্তন। যে সমাজ কে কুসংস্কারমুক্ত করতেই এমন বহু মনীষীরা তাদের জীবনের সর্বস্ব টুকু উজাড় করে দিয়ে গেছেন, তাঁদের সংস্কার মুখী চিন্তাধারা শুধুমাত্র রয়ে গেছে বইয়ের পাতায়। এতটুকুও বাস্তবে রূপায়িত হয়নি। কারন আজো এই অবক্ষয় সমাজে ধর্ম ধর্মের বেড়াজালে আপনার হাত রক্তে রঞ্জিত করি। সু-সভ্যতার রং লাগিয়ে নিজেদেরকে কখন যে অসভ্যতার দাসে পরিণত করে ফেলেছি তা বুঝতেও পারেনি কেউ। বর্তমানে সমাজের বুকে মেলবন্ধনের সেতুতে ফাটল ধরেছে। তা বোধ হয় আজ আমরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছি। এতোটুকু বদল হয়নি সামাজিক চরিত্রের কলঙ্কময় বৈশিষ্ট্য। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কলম গর্জে উঠেছিল এই সমাজের বুকে অসহায় দিন দরিদ্রের জন্য, পাষণ্ড অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে। পরাধীনতার যন্ত্রনা তার বুকে কুরে-কুরে খেত।তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে অত্যাচারী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্রে দীক্ষিত করার ডাক দেন।তাঁর কলমের ডগায় আগুন জ্বালিয়ে লিখেছিলেন দেশ বীরদের উদ্বুদ্ধ করতে। সমাজের বুকে ঘুমন্ত মানুষগুলোর ঘুম ভাঙাতে লিখেছিলেন –
“দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার হে
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার”।
দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করতে লিখেছিলেন অজস্র বিদ্রোহী কবিতা। তার লেখনীতে দুর্বল ভীরু কাপুরুষ রা উজ্জীবিত হয়ে, বিদ্রোহ করে তোলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। তাঁর মন্ত্র বীনার অমৃত সুধা পান করে দিশেহারা যুবসমাজ খুঁজে পায় আলোর দিশা। দেশের সন্তানরা মায়ের মুক্তির জন্য অবলীলায় দিয়েছেন হাজার হাজার প্রাণ। তাঁর প্রতি রইল আমাদের গভীর সমবেদনা ও আন্তরিক ভালোবাসা। যুগ যুগ ধরে তিনি আজও সবার হৃদয়ে মাঝে আলোকিত হয়ে রয়েছেন।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল শুধুমাত্র সুসাহিত্যিক নন, তিনি একাধিক গুণের অধিকারী ছিলেন। তিনি কবিতার সাথে সাথে লিখেছিলেন অজস্র গান। মুসলিম জাতির জন্য যেমন বিয়ের,মহরমের,দর বেশীর গানের সুর বেঁধেছিলেন, তেমনি অমুসলিমদের জন্য রচনা করেছিলেন বহু শ্যামা সংগীত।
“বল রে জবা বল
কোন সাধনায় পেলি রে তুই শ্যামা মায়ের চরণতল”।
তিনি ও অ-মুসলমানদের জন্য গান বেঁধে সামাজিক সমন্বয় গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তাঁর রচনা ধর্মের গণ্ডিকেও সারিয়ে বহুমাত্রিক রূপ ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিল। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকে বাংলার বৈষ্ণব ধর্মের পাশাপাশি শাক্ত ধর্মের উদ্ভব ঘটে এবং তাকে কেন্দ্র করে শাক্ত গীতি চর্চা ধারণা প্রচলিত হয়। এই সময়ে বঙ্গদেশে তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বৈষ্ণব ধর্মের চেয়ে শাক্ত দর্শন ও পূজা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। তবে শ্যামা সংগীত এর ধারণাটি বিকাশ লাভ করে খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতকে। আঠারো শতকের মধ্যভাগে সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন শ্যামা সঙ্গীতের প্রাণ সঞ্চার করেন। বাংলা সাহিত্য জগতে শাক্ত পদাবলী শ্যামা সংগীত নামে একটি বিশেষ সংগীত ধারা প্রতিষ্ঠা করেন। তবে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ শ্যামা সংগীত রচনা করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তৎকালীন সময়ে ভারত বর্ষ উত্তাল ছিল,একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর অন্যদিকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতি। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের গনগনে আগুনের আঁচ চারিদিকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। পুঁজিবাদী দেশগুলো আগ্রাসন নীতি শুরু করেছিলেন। সে সময়ে প্রতিবাদ ছিল নজরুল ইসলামের একমাত্র ভাষা। সাথে সাথে শাক্ত দর্শন ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল কাজী নজরুল ইসলামকে।
শাক্ত ধর্ম মানে শাক্ত বাদ। হিন্দু ধর্মের প্রধান তিনটি বিভাগের মধ্যে এটি ছিল অন্যতম ও ব্যাপক জনপ্রিয়। হিন্দু ধর্মের একটি শাখা সম্প্রদায় ছিল শাক্ত অনুগামীরা। হিন্দু দিব্য মাতৃকা শক্তি বা দেবী পরম ও সর্বোচ্চ ঈশ্বর, এই মতবাদের উপর ভিত্তি করে শাক্ত ধর্মের উদ্ভব আর এই শাক্ত দর্শন থেকে নজরুল শ্যামা সংগীত রচনা শুরু করেন। তিনি শ্যামা মায়ের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন-
“আমার হাতে কালি মুখে কালি
মা আমার কালি মাখা মুখ দেখে মা
পাড়ার লোকে হাসে খালি”।
শাক্ত পূজায় তার ভক্ত হৃদয়ের আকুলতা ও অকৃত্রিম আকুলতা ও আরতি রাঙা জবা গানে খুঁজে পাওয়া যায়। নজরুল ইসলামের শ্যামা সংগীত চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ “রাঙা জবা” ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয় ১০০ টি শ্যামা সংগীত রচনা নিয়ে। তৎকালীন সময়ে গ্রন্থটির মূল্য ছিল তিন টাকা। শুধু তাই নয় নারী শক্তির প্রতি নজরুলের ভগ্ন হৃদয়ের অকৃত্রিম আকুলতা চিরকাল ছিল। সেই ভাবধারার শুধুমাত্র শ্যামা সংগীত ও সংগীতে সীমাবদ্ধ ছিল না বরং কবিতার মধ্যে ও প্রকাশ পেয়েছিল। “ধুমকেতু”তে প্রকাশিত “আনন্দময়ীর আগমন” নামক কবিতার জন্য কবির এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। তাতেও ছিল নারী শক্তি সাধনার আরাধনা। তিনি লিখেছিলেন-
“আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল, আসবি কখন সর্বনাশী”।
কাজী নজরুল ইসলামের শ্যামা সংগীত জনপ্রিয় হওয়ার একমাত্র অন্যতম প্রধান কারণ ছিল আবেগের গভীরতা ও চিন্তার প্রসারতা।আবার কেউ কেউ মনে করেন নজরুল হৃদয়ের গভীর থেকে শ্যামার প্রতি ভক্তি নিবেদন করেছিলেন,সেই ভক্তি সঞ্চার হয়েছিল তার গানের ভাষাতে।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ধুমকেতু কাজী নজরুল ইসলাম শ্যামা সংগীত এর পাশাপাশি সৃষ্টি করেছিলেন অজস্র ইসলামিক গান। সেগুলি ইসলাম সমাজে গজল নামে পরিচিত। ইসলাম ধর্ম ইসলামী সংস্কৃতি জনপদের জীবনযাত্রা ও লোকাচারের প্রভাব এতটাই বিস্তার করেছিল যে, যুগের পর যুগ বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এক নতুন স্বতন্ত্র ধারণার জন্ম দিয়ে গেছেন। ইসলাম ধর্মের মৌলিক ধর্ম বিশ্বাসকে উপজীব্য করে রচিত হয় বাংলা গানের এক শক্তিশালী ধারা ইসলামিক গান বা গজল গান। সপ্তম শতকে আরব দেশে যে ধর্মের নবযাত্রা সূচিত হয়েছিল সেই ধর্মের উপাদান বর্তমান সময়ে ধারণ করে বাংলা ভাষা আধারে রচিত হয় এই সমস্ত গজল গান। এই সমস্ত ইসলামিক গান গুলো বাংলা গানের নিজস্ব সম্পদ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে সমাজের বুকে। তবে মধ্যযুগ থেকে বাংলায় ইসলামী গান রচনা যে প্রভাব দেখতে পাওয়া যায় তা আধুনিক ইসলামিক গানের রচনায় যে নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত তিনি আর কেউ নন আমাদের সবার প্রিয় কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর সৃষ্টিশীল হাতের ছোয়ায় বাংলা ইসলামিক গান,গজল গান,লোক গানের পর্যায় থেকে রাগ গানের পর্যায়ে আধুনিক গানের মর্যাদা লাভ করেন।বিংশ শতকে এসে বাঙালি মুসলিমরা আধ্যাত্মিক চাহিদা মেটাতে উর্দু কাওয়ালী গান শুনে আত্মতৃপ্তি মেটাতেন। লোক গানের আদলে ইসলামী গান সমাজে প্রচলিত ছিল। এমন বন্ধ্যা যুগে কাজী নজরুল ইসলাম আবির্ভূত হলেন মহীরুহ হিসাবে। তার অসাধারণ শিল্প কুশলতায় একের পর এক সৃষ্টি হতে লাগলো অনবদ্য সব ইসলামী গান। আর ইসলামিক গান হয়ে উঠলো বাংলা গানের নতুন শাখা রূপে।
0 Comments