একজন টিকটিকি (পর্ব – ৪)
আকাশে ছড়িয়ে আছে কালচে মেঘ। চারদিকে হাড়িয়া রঙের আলো। বাতাসে ভাসছে পাটপচা গন্ধ। হাত ত্রিশেক দূরে পীরপাল।পীরের সমাধি ঘিরে বুনো জঙ্গল। অন্যদিনের চেয়ে আজ সেই জঙ্গল অনেকবেশি কালচে সবুজ আর ঘন। তার মাঝে বিরাট বটগাছটা মনে হচ্ছে একটা বিরাট কাঠের হাতলওয়ালা ছাতা।খান কয়েক খেজুর গাছ দেখে মনে হচ্ছে সাদাটে চন্দ্রবোড়া সাপ।
যোগেন বেশ খানিকক্ষণ ভাবার পর বুঝল খেজুর গাছের আসল রং ধুয়ে মুছে গেছে বলেই হয়ত তার চন্দ্রবোড়া সাপের কথা মনে পড়েছে।
এর বেশি কিছু নয়।
জবুথবু হয়ে বেশ কিছুক্ষণ হল বসে আছে যোগেন। সে জানে দীনবন্ধু আসবেই। একবার ভেবেছে যাবে না, কিছুক্ষণ পর মনে হয়েছে যাবেই। এখানে পড়ে থেকে সে কী পেয়েছে? কেন থাকবে? কে আছে তার!
অনেকক্ষণ একভাবে বসে থেকে যোগেনের পা ঝিনঝিন করছে। তবু সে বাঁশের মাচা থেকে নামল না। অপেক্ষা করতে লাগল। কেন জানি মনে হচ্ছে যার জন্য অপেক্ষা তিনি আজ আসবেন না।
বারবার রাস্তার দিকে চোখ চলে যাচ্ছে তার।পকেটে টিকটিকি নিয়ে ঘোরা মানুষটা এখনও আসছে না কেন?
দীনবন্ধুকে সে প্রথম দেখেছে তিনদিন আগে। বৃষ্টির মধ্যে মাঠের কাজ ফেলে সুরেশ মন্ডল ভিজবে বলে ছুটে এসে দেখেছিল লোকটাকে। বাঁশের মাচার এককোনে বসে আছে সুরেশ মন্ডল। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, লম্বা রোগা পাতলা একটা মানুষ। চোখে পড়েছিল তাকে আসতে দেখেই চটপট হাতে থাকা একটা টিকটিকি পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল মানুষটা।
যোগেন অবাক হয়েছিল দেখেই বুঝি আপন মনে বলেছিল, “ও আমার সংগেই থাকে। পোষা। তোমার যেমন ফড়িং আছে আমার আছে টিকটিকি। “
“আমার ফড়িং আছে এ কথা আপনি জানলেন কেমন করে? “
“এসব জানাই আমার কাজ। চন্দ্রবোড়া সাপের কথাও জানি!”
“চন্দ্রবোড়া সাপের ঘটনাটা জানলেন কেমন করে?”
“শুধু ফড়িং জানব সাপ জানব না, এটা আমার ধাতে নেই যোগেন।যাইহোক এই বৃষ্টি সহজে ছাড়বে না। আমার কাছে একটা ছাতা আছে যাও ওনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এস। আমি তোমার জন্য এখানেই অপেক্ষা করব।”
সুরেশ মন্ডল চাপা গলায় বলল, “আমায় বাড়িতে রেখে আয় যোগেন।আমার প্রেসারের ওষুধটা এখনও খাওয়া হয়নি।শরীরটা ভাল ঠেকছে না।”
যোগেনের কাঁধে ভর দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় সাবধান করেছিল সুরেশ মন্ডল ,”ছাতা এনেছিস তা ফেরত দিয়ে সঙ্গেসঙ্গেকেটে পড়বি। দীনবন্ধু সুবিধার মানুষ না। সে পারে না এমন কাজ নাই। খুন করেছে।জেল খেটেছে।”
“লোকটার নাম বুঝি দীনবন্ধু?”
“হুম, দীনবন্ধু সম্পর্কে যত কম জানবি তোর পক্ষে তা ভাল। মনে থাকবে তো আমার কথা?”
“থাকবে। আমি ছাতা ফেরত দিয়ে আর দাঁড়াব না।”
যোগেন পারল না। ছাতাটা ফেরত দিতে এসে দেখল হাতে টিকটিকি নিয়ে বসে আছে দীনবন্ধু মন্ডল। তাকে দেখেই বলল, “চুপচাপ বসে পড়।আমার কিছু জরুরী কথা বলার আছে।”
“তার আগে বলুন চন্দ্রবোড়া সাপের ঘটনাটা জানলেন কেমন করে?”
” এসব বলতে গেলে অনেক বকবক করতে হবে। এতটা সময় তোমার আছে?”
“আমার তো তেমন কাজ নাই, শুধু কোদালটা জমিতে ফেলেই ছুটে এলাম বলে আবার ওটা আনতে মাঠে যাব।”
“খিদে পায়নি তোমার? একা থাকো। নিজেই রান্না করে খাও?”
“দিনে রান্না করি না।রাতে কিছু ফুটিয়ে নিই।সকালে গঞ্জে গিয়ে দুখানা বাসি পরোটা আর দু প্লেট তরকারি খাই। সন্ধে অব্দি পেট নিয়ে ভাবতে হয় না।আজ অবশ্যি খিদে খিদে পাচ্ছে। মনেহয় পরোটা দিতে ভুল করেছে। পরোটা টাটকা ছিল।নয়ত এত তাড়াতাড়ি খিদে পাওয়ার কথা নয়।”
“ওরা মানে ওই মিষ্টির দোকানদার তোমায় টাকা দেয় না?”
“না।”
দীনবন্ধু হাসল, “তুমি সকালে ঝাড়ঝুড় দাও, জল আনা বাসন মাজার মত কাজ করো তার বিনিময়ে স্রেফ দুটো বাসি পরোটা।”
“তরকারি দেয় প্লেট ভরা । বাড়তি চাইলে একটু খিচমিচ করে তবে একেবারে না করে না। দোকানের কর্মচারী ছেলেটা খুব ভাল।মালিক অন্যমনস্ক থাকলে মিষ্টির রস প্লেটে ঝুপ করে দিয়ে হিন্দিগান করতে করতে অন্য দিকে চলে যায়।আপনি কিন্তু এখনও বললেন না চন্দ্রবোড়ার কথা।”
পকেট থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করে দীনবন্ধু বললেন, “এটা রাখো। আমার কথা ফুরোলে ওই মিষ্টির দোকানে গিয়ে খাবে। মালিককে বলবে তুমি শহরে কাজ পেয়েছ।কাল সকালেই গ্রাম ছাড়ছ।”
“মিথ্যে বলব?”
“না, তুমি সত্যিই কাজ পেয়েছ। এখন থেকে আমার সঙ্গেথেকে কাজ করবে।”
“কী কাজ?”
“তুমি যেমন করে রাতে সাপের সঙ্গেথাকো আর বাইরে ফড়িং নিয়ে ঘুরে বেড়াও ঠিক তেমন কাজ। আজ থেকে চুপচাপ দেখাটাই তোমার একমাত্র কাজ।অনেকটা টিকটিকির মত চোখ ঠিকরে দেখবে আর মনে রাখবে।”
“আমি পারব?”
“পারবে।খুব পারবে।”
“আমার ঘরে চন্দ্রবোড়া আসে তা আপনি কেমন করে জানলেন?”
দীনবন্ধু বেশ শব্দ করে হাসল, ” একসময় ভাবা হত চন্দ্রবোড়া বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এসব ধরে নেওয়া কথা। জীবনে এসব কথার দাম নাই। তুমিও এসব কথা পাত্তা দেবে না।
যা বলছিলাম,এই গ্রামের খবর আমি রাখি।গতবছর খবর পেয়েছিলাম, চন্দ্রবোড়ার ভয়ে ধান কাটা যাচ্ছে না। তিনজন মানুষ মারা গেল এর কামড়ে। একজনের পা কেটে ফেলেও বাঁচানো যায়নি।
অঘ্রাণের প্রথম মংগলবার কানু মন্ডলের ছেলে বিলাসকে ছোবল দেয় চন্দ্রবোড়া। চিকিৎসার জন্য গঞ্জের কোয়াক ডাক্তারের কাছে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। অবস্থার খারাপ হতে থাকলে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসা চলাকালীন বিলাস মারা যায়।
এর তিনদিনপর মারা যায় বিলু দাস,ওকে প্রথমে ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই সপ্তাহেই আরেকজন মারা যায় তার নাম নরহরি। নরহরির পা বাদ দিয়েও ওকে বাঁচানো যায়নি।”
“আপনি এত কিছু জানেন?”
“আমি নরহরিকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম । ও বলছিল ফড়িং… ফড়িং.. ওর কাছে ওরা আসে। সবাই ভেবেছিল ভভুল বকছে।পরে খোঁজখবর করে তোমার কথা জানতে পারি। প্রত্যেকটা ঘটনা ঘটেছে তোমার ঘরের কাছে।ওরা ফড়িং খেতে আসে।তাইনা?”
“হতে পারে। আমার ঘরে সন্ধের পর ভরে যায়।আর সাপ আসে। আমার প্রথম প্রথম খুব ভয় হত। ঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতাম।যেখানেই যাই ওরা আসে।শুনেছি ওদের দাঁত বড় তাই বেজায় শব্দ করে।”
” আর কথা নয়। কাল বিকেলেএখানেই অপেক্ষা করবে, আমি এসে তোমায় নিয়ে যাব।শর্ত একটাই, সবকথা বাইরে বলা যাবে না।”
সন্ধে হয়ে এল। দীনবন্ধুর জন্য তবু বসে রইল যোগেন।
পড়ুন, এই ধারাবাহিক উপন্যাসের আগের পর্ব।
0 Comments