ঘ্রাণ
বৃষ্টিতে অশ্বত্থগাছটার পাতা ধুয়ে যাবার পর একটা আচ্ছন্ন করে দেওয়া গন্ধ ঘরটা জুড়ে আছে। বাইরের ঘরের জানলা দিয়ে দেখতে পেল একটি মারাঠি মেয়ের ছায়াটা এগিয়ে আসছে। বড় অনুজ্জ্বল বেশবাসের সে। কোথাও যেন তার ঝলমলে ভাবটা সে যেন ভুলে ফেলে এসেছে। ঘরের মধ্যে ঢুকে এসে তার মৃদু কম্পন স্পর্শটুকুই সম্বল করে মেয়েটি দু পা এগিয়ে রণধীরের সংলগ্ন হতে চায়।
এসময় একলা থাকাটা বড় কষ্টকর। যুদ্ধের বাজারে যেন গোটা দেশটায় তালা পড়েছে। ইংরেজী কাগজ একটা আসে বটে, একলা ঘরে নিজের সিঙ্গল বেড নেয়ারের খাটটাতে আধশোয়া হয়ে কমসে কম সারাদিনে একশোবার পড়ে বিজ্ঞাপনগুলোও এখন মুখস্থ হয়ে গেছে। এই অনুত্তেজক দিনটায় আপাতত ওই মেয়েটি যদি এইবার একটু আনন্দ দিতে পারে!
ওপারে একটা কাঁটাতারের কারখানা আছে। মেয়েটা বোধহয় ওখানেই মজুরী করে। ওটা একটা ইনকামের উৎস। এছাড়াও টাকা রোজগারের আছে অন্য আরেকটা পথ। সেটা অবশ্য সবাইকে ডেকে বলা যায়না।
এলাকার ফিরিঙ্গি মেয়েগুলো এই কদিন আগে পর্যন্ত বেশ সস্তা ছিল। এখন ওদের যুদ্ধের বাজারে সেবিকার কাজে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। শ্বেতাঙ্গ সেনাগুলো এখন বুট বাজিয়ে ওদের জন্য নির্দিষ্ট পানশালায় যখন যায়, এই মেয়েগুলোই মজুত থাকে সেখানে। দেশী কালোচামড়ার লোককে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয়না, এটাই দস্তুর।
রণধীর মোটামুটি বোম্বাই এর নাগপাড়া থেকে তাজ হোটেল অবধি এলাকায় অনেক ফিরিঙ্গি মেয়ের সাথেই শুয়েছে। ওদের প্রেম ট্রেমের হাজারো ব্যর্থতার কাঁদুনির পর ওরা শেষপর্যন্ত কোনও না কোনও অপদার্থ লোকদেরকেই যে কেন বিয়ে করে ফেলে সেটা বোঝা দায়!
হ্যাজেল নামের ওই ফিরিঙ্গি মেয়েটা রণধীরের নীচের ফ্ল্যাটেই থাকে। ছোট করে তার হালফ্যাশনের চুলের ছাঁটটার সাথে খুব উদ্ধত বুকদুটো যেন উর্দির বোতাম ছিঁড়ে দৃশ্যমান হতে চায়। সে রাস্তায় নামলে লোভী কুকুরের দৃষ্টিতে বাইরে সবাই ওকে চোখ দিয়ে চাটতে থাকে । অবশ্য এরকম দেহশৈলী থাকলে লোকে আর কি করবে! হ্যাজেল ওসব ভ্রূক্ষেপ করেনা। তার রুমমেট মেয়েটির সাথে সবরকম গল্প এমনকি অনিয়মিত পিরিয়ডস্ নিয়েও জোরে জোরে আলোচনা করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসে। এরা সত্যিই একেবারে অন্যরকম। দূর থেকে ভেসে আসা বাজনার আওয়াজ কানে এলে আপনিই এদের পা ‘ নেচে ওঠে, দোলে কোমরও…..
আজকের আগে রণধীর কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি এরকম একটা গ্রাম্য মারাঠি মেয়েকেও তার কখনো প্রয়োজন হতে পারে । মেয়েটা ঘরে ঢোকার পরই ও দেখল একটু আগের হয়ে যাওয়া বৃষ্টিতে ভিজে মেয়েটার কাপড়জামা সবটা সপসপ করছে। এরকম ভাবে আর কিছুক্ষণ চুপ্পুড় ভিজে কাপড়ে থাকলে অন্তত নিউমোনিয়া হয়ে যাওয়াটা বিচিত্র নয়।
‘ কাপড়গুলো আগে ছেড়ে ফেল!’ রণধীর একজোড়া শুকনো কাপড় তার দিকে বাড়িয়ে দেয়। এইবারে মেয়েটা যেন সম্বিত ফিরে পায়। বুঝতে পারে উন্মোচনের ইঙ্গিতটাই আসলে, অন্যভাবে পেশ হল এতক্ষণে।
মেয়েটার গায়ে কাঁচুলিটা খুব এঁটে বসে আছে আর এরকম ভাবে ভিজে যাওয়ার জন্য গিঁটটাও খোলা যাচ্ছেনা কিছুতেই। মেয়েটা রণধীরকে খুলে দিতে চোখ দিয়ে ইশারা করলো।
কুমোরের চাকায় একতাল মাটি যে ভাবে পাক খেয়ে কলসীর আকারে সেজে ওঠে, রণধীর পিছন থেকে এসে কাঁচুলির গিঁটটা খুলতেই ঠিক তেমন অনুভূতি হল। নরম পেলব স্তনদুটিতে কেমন যেন মাটি মাটি গন্ধ। বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া অশ্বত্থপাতার শিরায় এমন গন্ধ লেগে থাকে।
সারারাত ধরে মেয়েটিতে নিবিষ্ট হতে হতে রণধীর টের পাচ্ছিল যে এতদিনকার অভিজ্ঞতার সাথে আজকের রাতটার অনুভূতিটা তার কিছুতেই মিলছে না! কে যেন একটা বৃষ্টিধোয়া সোঁদা গন্ধটা লেপে দিয়েছে কেউ মেয়েটার সর্বাঙ্গেই। ঘাড়, বুক, নাভী এমনকি ঈষৎ নরম বগলতলির কেশগুচ্ছে…সবেতেই ওই মাটির গন্ধ। বৃষ্টিধোয়া মাটির সেই খুব চেনা গন্ধটা, আর খুব মনকেমন করা সেই গন্ধ আচ্ছন্ন করে দেয় দেহবিকার।
এই ঘরের এখন আসবাব বেড়েছে। একটা নেয়ারে সিঙ্গল খাটের পাশে এখন আর একটা নতুন খাট এসেছে। এসেছে ড্রেসিংটেবিলও। আবারও একটা বৃষ্টিধোয়া দিন, আবারও একটা ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের উপস্থাপনা হবার আয়োজন চলছে। একজন অত্যন্ত ফর্সা যুবতী ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে ধীরে ধীরে উন্মোচন করছে নিজেকে। যুবতীটি রণধীরের সদ্য বিবাহিত স্ত্রী। তার লাল রঙের রেশমী সালোয়ারটা আপাতত ইতঃস্তত ছড়ানো। সোনালী ফুলের পাপড়ির মত কামিজটাও বিছানায় এখন খুলে রাখা আছে। সে সলজ্জ ভঙ্গিতে এগিয়ে যায় স্বামীর সদাচঞ্চল হাতদুটিকে পুরস্কৃত করতে।
রণধীরের হাতটা হাওয়ার মত তার স্ত্রীর সর্বাঙ্গে বেড়িয়ে আসতে চায়। সে নিজের হাতে যত্ন করে ব্রেসিয়ারের হুকটা আলগা করতেই একদলা মাখনের মত সতেজ আর ফর্সা বুকজোড়া তার হাতের নাগালে এসে পড়ে। মেয়েটির শরীরে সবকিছুই যথাযথ ও সুন্দর। অনাবশ্যক নির্মেদ, এমনকি দেহসন্ধিগুলিও পরিচ্ছন্ন।
বাইরে বৃষ্টিধোয়া অশ্বত্থগাছের পাতার গন্ধটা ঘরময় ছড়িয়ে আছে। ঠিক সেদিনকার মতোই। তফাৎ এই যে সেই দরিদ্র মারাঠি মেয়েটার গায়ে মাটির সোঁদা গন্ধটা, ক্ষুধা আর দারিদ্রের ওই করুণ গন্ধটা যেটা তাকে সেদিন বিমোহিত করে তুলেছিল সেটা আজ আর নেই। আজকে সবটা বড় সাজানো, রক্তশূন্য, জীবনহীন আর ফ্যাকাশে ঠেকছে যেন। সেই মাটির বনজ ভেজা ঘ্রাণ, আর ভিতরে চারিয়ে যাওয়া শিকড়ের ঘ্রাণের সম্মিলীত অনুপস্থিতিটুকু যেন নিভিয়ে দিয়ে যাচ্ছে রণধীরকে বারবার।
কয়েকবার ব্যর্থ হবার পর আর একবার, নতুন উদ্যমে রণধীর তার নব্যবিবাহিত সুন্দরী স্ত্রীর শরীরে নিবিষ্ট হওয়ার জন্য মনপ্রাণ দিয়ে সেই ফেলে আসা মাটির গন্ধটাকে নিজের মধ্যে পেতে চাইছিল। বাইরে বৃষ্টিধোয়া অশ্বত্থগাছের পাতার ভিজে গন্ধের সাথে যা কবেই ওই গরীব মারাঠি মেয়েটার গায়ের গন্ধের সাথে মিশে এক হয়ে গেছে।
(সাদাত হাসান মান্টোর ছোট গল্প ‘Smełl‘ – এর অনুবাদ)
0 Comments