স্নেহধারা
আমাদের পাড়ার শেষ প্রান্তে একটি গরীব পরিবারের বাস ছিল। হার জিরজিরে কয়েকটা ঘর।ভাঙাচোরা বেড়া দেওয়া এক ফালি উঠোন। কোনে একটা লাউমাচা। তার আশপাশে কিছু নয়নতারা, কিছু বেলি–টগরের গাছ। বাড়ির উঠোনটা গোবরে নিকোনো থাকতো। কেননা টাকা পয়সার অভাব থাকলেও তাদের গোবরের অভাব ছিল না।
আমাদের অনেককেই সেখানে যেতে হতো। সেই বাড়ির একমাত্র আয়ের উৎস ছিলো কয়েকটি গরু। গরুর দুধ আর ঘুঁটে বেঁচে সম্ভবত তাদের সংসার চলতো।মাঝে মাঝে ঘি তৈরি করে তাদেরকে দেখা যেত পাড়ার বিভিন্ন বাড়িতে বিক্রি করতে।
রোজ বিকেলের দিকে আমরা জড়ো হয়ে যেতাম খাঁটি দুধ নিতে। একটা অ্যালুমিনিয়ামের দুধ ভান্ডার হাতে নিয়ে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামার মুখে আমরা অনেকেই সে বাড়িতে হাজির হতাম। আমাদের সামনেই দুধ দুইয়ে ফেনাময় উষ্ণ দুধ আমাদের পাত্র গুলোতে মাপ করে ঢেলে দেওয়া হতো। আমরা ধীরে সুস্থে গল্পগুলোকে যতদুর সম্ভব টেনে বাড়িয়ে নেওয়া যায়, নিয়ে বাড়িতে যেতাম। কেননা সেই দুধ ফুটিয়ে গরম গরম পরিবেশন করা হবে আমাদের এক ঘেয়েমির পড়তে বসার শক্তি যোগাতে। আমাদের ঘুমে আরক্ত চোখের পাতাদুটোর সমস্ত আবেদন অস্বীকার করে মৃদু আলোয় বইয়ের কালো অক্ষরগুলোর দিকে চেয়ে থাকতে হবে বহুক্ষণ।
সেসময় মুংলি নামের একটা কালো গাইয়ের দুধ দুইয়ে আমাদের দেওয়া হতো। সুনীল ওরাও নামের বেঁটে মতো গাট্টাগোট্টা লোকটি একটু সর্ষের তেল নিয়ে একটা পরিষ্কার অ্যালুমিনিয়াম বালতি নিয়ে মুংলির কাছে বসতো। প্রথমে গরুর ছটফটে বাছুরটাকে সুযোগ দেওয়া হতো। বাটে মুখ লাগিয়ে তার ছোট্ট মাথাটা দিয়ে মুংলির স্তনে হালকা একটা গুতো দিয়ে সে দুধ টানা শুরু করতো। কিছুক্ষন বাদে সুনীল ওরাও এর কালো মতো বউটি বাছুরটাকে টেনে ধরতো। তখন সুনীল ওরাও নিপুন হাতে দুধ দুইয়ে নিয়ে পাত্রটা ভরে ফেলতো। দোহনের পর মুংলির অবশিষ্ট নির্যাসটুকু পাওয়ার অধিকার ছিলো তার বাছুরটার।
আমরা বহুদিন দেখেছি মুংলির বাছুরটা বিদ্যুতের মতো ছোটাছুটি করছে সুনীল ওরাওদের বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গাটায় আর মুংলি বাঁধা রয়েছে তার চারিতে। চারিতে মুখ ডুবিয়ে, ল্যাজ দিয়ে মাছি তাড়াতে তাড়াতে সে তার বাছুরের ছোটাছুটি দেখতো। মেটে রঙের দুর্দান্ত ক্ষিপ্র বাছুরটা অনেক ছোটাছুটির পর হাফিয়ে উঠলে তার মায়ের কাছে গিয়ে কোল ঘেঁষে দাঁড়াতো। চারি থেকে মুখ তুলে মুংলি তার বাছুরের গায়ে পরম স্নেহে জিভ বুলিয়ে দিত।
একদিন দুধ নিতে গিয়ে দেখেছিলাম – সুনীল ওরাও আর তার বৌএর মুখটা ভারী থমথমে হয়ে আছে। বাছুরটা কিভাবে যেন মারা গিয়েছে। তখন আমরা জানতাম না বাছুর না দেখলে গাই দুধ দেয়না। কিন্তু দুদিন বাদে বাড়ি থেকে আমাদের আবার দুধ নিতে সুনীল ওরাও এর বাড়িতে যেতে বলা হলো।
দুধ নিতে গিয়ে আমরা আবার বাছুরটাকে দেখতে পেয়ে প্রথমটায় চমকে উঠেছিলাম। বাছুরটা যেন শুকিয়ে দড়ির মতো হয়ে গেছে। তার মেটে রঙের শরীরটার যেন আর কোনো জেল্লা নেই।চার পায়ে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছে। চোখদুটো বন্ধ। আমরা কাছে গিয়ে দেখেছিলাম – বাছুরটা চামড়ার ভিতরে খড় পোরা হয়েছে। সেই এমবামিং করা বাছুরটা ধরে একটু তফাতে দাড়িয়ে আছে সুনীল ওরাও এর কালো কুচকুচে বউটা। আর সাদা দুধ ঝরঝর করে ঝরে জমা হচ্ছে সেই অ্যালুমিনিয়ামের বালতিটায়। মুংলির দুচোখ বেয়ে নোনাজলও নেমে আসছিল অঝোর ধারায়। দুধ দেখে সুনীল ওরাও আর তার বউয়ের মুখে হাসি ফোঁটে। তারা ওরাও ভাষায় হেসে হেসে কি সব যেন বলাবলি করছিল। ব্যাপারটা এমন যে, তারা বিরাট কোনো দুশ্চিন্তার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।
আমরা এমবামিং করা বাছুরটার দৌলতে দুধ পাচ্ছিলাম। সুনীল ওরাও এর দুধ বেঁচে সংসার চলছিল। মুংলির চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়া নোনাজল দেখেও সেদিন বুঝিনি – মা কে বোকা বানানো সহজ নয়। এরপর একসময় বাছুরটার খরপোরা দেহ ক্রমশ ফ্যাকাশে হতে থাকে। তাকে সামনে আনা অনর্থক হয়ে পড়ে। কিন্তু মুংলি আমাদের দেখে তার সাদা স্নেহ ধারা বিলিয়ে গেছে। আমরা কোনোদিন দুধ আনতে না গেলে মুংলির স্তন ক্ষরণের কথা কিভাবে যেন ভুলে যেত।
…………………………………………………..
0 Comments