পুনশ্চ
ঘরটির নাম পুনশ্চ।এই ঘরে বেশ কয়েকদিন হল লেখা আর ছবি আঁকা নিয়ে তিনি মেতে আছেন। আজ রাতে এখানে থাকবেন বলে কাঠের বাক্স জুড়ে বিছানা করেছেন।
ডিসেম্বরের ঠান্ডা রাত। অল্প আলোয় কলমের আচড়ে সদ্য আঁকা কিশোরীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। মুখটা কেমন চেনা চেনা লাগছে! কিন্তু ঠিক কার মতো তা বুঝে উঠতে পারছেন না।
দরজায় ঠক্-ঠক্ শব্দ হল।
— কে? এত রাতে…..?
পুরুষ কন্ঠ ভেসে এল,কথা ছিল…. জরুরী কথা। নিরুপায় হয়ে এসেছি।ঘরে আসবার অনুমতি দিলে সবটা বলতে পারি।
— এসো।
ঘরে এল যুবক। গায়ে শাল তবু কাঁপছে। যেন বহুদূর থেকে এসেছে। ক্লান্ত,অবসন্ন।
সামনে একটা ফাঁকা চেয়ারে বসে ঘরের চার পাশটা দেখতে লাগল। যেন সে কথা হারিয়ে ফেলেছে। একসময় হারিয়ে যাওয়া কথাগুলো খুঁজে পেতেই শুরু করল, আমায় চিনতে পেরেছেন? আমি উলাপুরের সেই পোষ্টমাস্টার।আপনি দয়া করে আবার সেখানে আমায় পাঠিয়ে দিন। আমার এই শহরটা আর ভাল লাগছে না।
—কেন?
— এখানে চিঠির জন্য কেউ ব্যাকুল নয়। সব কেজো চিঠি। অপেক্ষার চিঠি নেই। ভাল খবর নেই।
— শুধু এইটুকু!
যুবক চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ তার পর কাঁপা- কাঁপা গলায় বলল,যা ছেড়ে এসেছি তার জন্য মন কেমন করে।
—সমস্ত দিন কি আকাশ দেখে গাছেদের ছায়া দেখে জীবন সুখের করে তুলতে ইচ্ছে করে?
— আমি ঠিক বুঝতে পারি না।আপনার ঘরে এসে দেখছি আপনি ঠিক আমার মত। শুনেছি বারবার ঘর পাল্টাচ্ছেন। আর মনে মনে শান্ত ছায়াটুকু আঁকছেন। যেন রতন।
—রতন কে তোমার মনে পড়ে?
—– খুব। খুব মনে পড়ে। আমি যখন বললাম, বাড়ি যাচ্ছি রতন। সে বলল, কবে আসবে দাদাবাবু? আমি ঝড়ের আগের শান্ত গাছ হয়ে সময় গুনছি, ভাবছি কি বলি.. কি বলি! আপনি জোরের সংগে বলিয়ে নিলেন… আমি বললাম, আর আসব না। ও চুপ করে গেল। কেন এমন নিষ্ঠুর করে তুললেন আমায়! আমি চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই জীর্ণ চাল ভেদ করে মাটির সরার উপরে বৃষ্টির জল পড়ছে। রতনের চোখের নীচে টলটল করছে নিরবতা। ফিরতে চেয়েছিলাম, পালে তখন বাতাস, আপনি কানে কানে বলতে লাগলেন, জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ,কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া লাভ কি? আপনি বার বার আমায় নিয়ন্ত্রণ করেছেন।আজ দয়া করুন… আমায় আবার উলাপুরে নিয়ে চলুন। কথা শেষ করেযুবকটি চোখের জল আড়াল করতে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
তা সম্ভব নয়…এই টুকু বলতে গিয়ে তার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। এভাবেই বসে রইলেন দুজন কান্না লুকানো মানুষ।অনন্তকাল।
0 Comments