রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা
লোকটা মাথা নিচু করে মন দিয়ে ফোটো বাঁধছিল । দোকানের সামনেই একটা বাইক এসে থামল । হেলমেট পড়া লোকটাকে ভাল করে দেখা না গেলেও তার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল । আর পেছনে বসা ছেলেটির মাথায় হেলমেট না থাকায় তাকে দেখা গেল স্পষ্ট । বেশ সুকান্ত টাইপের চেহারা । নাম জিজ্ঞেস করলেই যেন বলে দেবে আমার নাম স্থিতপ্রজ্ঞ বন্দ্যোপাধ্যায় । বা এমনই প্রচণ্ড সিরিয়াস কিছু । ফোটো বাঁধাইএর ছেলে পেছনে হাঁটু দ’ করে বসে কাগজের লম্বা লম্বা ফোটোগুলি গুছিয়ে রাখছিল । সে হা করে হেলমেট মাথার দিকে একবার , সুকান্তর দিকে একবার তাকায় । ধরা যাক তার নাক ছোট্কু , এসব ছেলেদের এমন নামই হয়ে থাকে । এদের বৈশিষ্ট্য হল যতক্ষণ না মা বাড়ি থেকে ফোন করে বলবে , আয়রে বাবা প্রাইভেট মাস্টার বাড়ির সামনে সাইকেলে ঘন্টি বাজিয়ে দিয়ে গেল । এখনই পটাইদের বাড়িতে ব্যাচ বসে যাবে। শিগ্গির করে বাড়ি আয় বাবা । ততক্ষণ বাবার পাশটিতে বসে কাগজ কাটবে । ছবির পেছনে আঠা লাগাবে । আর বাবার মুখ থেকে আলফাল গল্প শুনবে । ঠিকঠাক জায়গায় কথার লেত্তি লাগাতে পারলে , বাবার স্টকের দু’দশটা জিকের প্রশ্নের উত্তর লাগিয়ে দিতে পারলে পাঁচটা টাকা বখশিস পাওয়া যেতে পারে । তখন আবার প্রাইভেট শেষে মহেন দার চপের দোকান । স্থিতপ্রজ্ঞরা চপের দোকানে যায় না । অলিভ রেস্টুরেন্টের ঠান্ডা ঘর আর মুরগির গরম ঠ্যাং এর মাঝে বাবা মায়ের গম্ভীর হেলমেট ।
– রবীন্দ্রনাথের ফোটো আছে রে ?
– ফোটো বাঁধাই পেছন ফিরে বলে , ছিল তো । দেখ তো বাবা । পোট্রেট সাইজগুলির মধ্যে খোঁজ ।
– তাড়াতাড়ি দ্যাখ , তাড়াতাড়ি দ্যাখ । তুই দ্যাখ না । বাচ্চা ছেলে কতক্ষণে খুঁজে পাবে কি না পাবে ।
– পেছনের ছেলেটা , মাথা উঁচু করে একবার হেলমেটের দিকে তাকায় । পেছনে বসা সুকান্ত তারও পেছনে পিঠে ঝোলানো আমেরিকান ট্যুরিস্টার ব্যাগ থেকে কনুই উলটে জলের বট্ল বের করে গলায় ঢালে । – তুমি নেবে পাপা ?
– নো থ্যাংকস । কি রে পেলি ?
– খুবই তাড়া দেখছি স্যারের । একটু দাঁড়ান । আসুন না । চেয়ারে বসুন স্যার । সামনে রাখা রোদে পোড়া একটা প্লাসটিকের চেয়ার দেখিয়ে দেয় ফোটো বাঁধাই ।
– নানা , তুই দ্যাখ । নেটে বহু আছে । কিন্তু প্রিন্ট কোয়ালিটি ভাল হবে না । এর স্কুলে আবার পোস্টার বানাতে হবে । এমন সব হুজ্জতি করে না ! গাদা গুচ্ছের টাকা দাও মাসে মাসে । আরে ভাল ভাবে পড়া , তা না । রবীন্দ্রনাথের পোস্টার বানাও । গোবিন্দ্রনাথের মূর্তি বানাও ।
– হ্যা কাল বাইশে শ্রাবন কিনা ।
ছবিওয়ালা স্নিগ্ধ ভাবে নিজের ছেলেটির দিকে তাকায় ।
-হ্যা , রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তী । তাই পোস্টার বানাতে দিয়েছে ।
দোকানদার আর তার ছেলে চকিতে একবার সামনে তাকায় । পেছন থেকে সুকান্ত টাইপ পাপার পেছনে একটা বোতলের খোঁচা মেরে কোঁৎ করে জলটা গিলেই বলে , সিলি বয় । ট্যাগোরস ডেথ ডে ।
-ওই একই হল । যাহা ফিফটি টু তাহাই ফিফটি থ্রি । নে । এখনকার ছেলেদের জিকে পাওয়ার বেশ চৌকস । কি রে পেলি ?
-নেই রে । পেছন থেকে ছোট্কু টাইপের ছেলেটা চিৎকার করে ওঠে ।
-নেই ! বেশ হতাশ হয় বাইকওয়ালা । এতক্ষণে হতাশায় হেলমেট খুলে ফেলে । ফোটোওয়ালা চশমা ঠিকঠাক করে দেখে নেয় নেহাত ছোকরা টাইপের লোক । এই হৃতিক রোশনের ছবির মত হবে । দুই বাই তিন ।- ইসসস নেই । আরে তুই তো গোটাটা দেখলিই না । ওপাশের লটটা দেখ ।
-দেখলাম তো রে । আগেই দেখে নিয়েছি আমি । তোরা আসার আগেই ।
-আরে ছোঁড়া তুই তোকারি করছিস কাকে বলত ?
-তোর পেছনের ছেলেটাকে । আপনার পেছনের ছেলেটাকে । নেই রে দোস্ত ।
হৃতিক রোশন খুব কষ্টে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে – মাই গশ। চিনিস নাকি । সেম স্কুল ?
-নেভার সিন ইন মাই লাইফ । রাবিশ ।
বুড়ো আঙুলের চাপে বাইক ঘোড়া ডাক ছেড়ে , সিন থেকে আউট হয়ে যায় ।
ছোট্কু টাইপের ছেলেটা বাবার পেছন থেকে দুই বাই তিন রবীন্দ্রনাথের ফোটোটা বের করে শূন্যে মেলে ধরে ।
ফোটোওয়ালা চশমা ঠিকঠাক করে , যথাসম্ভব গলাটা গম্ভীর করে নিয়ে , এসব সময় বাবাদের এসব করতে হয় , বলে – বড় ফাজিল হয়েছিস রবীন ।যা বাড়ি যা । এই নে ।
পঞ্চাশ টাকার নোটটা হাতে নিয়ে রবীন দোনামনা করে বলে , বোতল কাকুর দোকান থেকে খুচরো করে নিয়ে আসব ?
-নাঃ গোটাটাই রাখ । কাল তোর জন্মদিন । কিছু কিনে খাস । চশমার কাঁচ কোমল হয়ে ওঠে ।
খুব খুশি হয়ে রবীন ওরফে রবীন্দ্রনাথ মণ্ডল ফরটি ফাইভ ডিগ্রি ঘাড় কাত করে দোকান থেকে বের হয়ে যায় ।
0 Comments