ভয়চরিত
“চিত্ত যেথা ভয়যুক্ত, উচ্চ যেথা শির”
থুড়ি! থুড়ি! একটু ভুল হয়ে গেল, রবিদা যুক্তর জায়গায় শুন্য লিখে ছিলেন। এহ্! কি সাংঘাতিক ভুল মাইরি, ভদ্রলোক বেঁচে থাকলে নির্ঘাৎ কানমলা খেতাম। আসলে দোষটা কিন্তু পুরোপুরি আমাকে দেওয়া যায় না, ছোটবেলায় শোলে সিনেমা দেখার সময় গব্বরের বিখ্যাত সেই ডায়লগটি যখনই আসত- “যো ডর গ্যাইয়া ভো মর গ্যায়া”। তখনই পাশ থেকে বড়রা কেউ না কেউ বলে উঠত – “অর যো নেহি ডরা সামঝো পেহেলে মর গ্যায়া।” ঠিক যেন ভুল সংশোধন করে দিচ্ছে। এছাড়া উঠতে বসতেঃ”ভয় পাস না?”, “তোর প্রাণে কি কোন ভয় নেই?”, “কি দস্যি মেয়ে রে বাবা ভয় ডর বলে কি কিছু নেই” ইত্যাদি ইত্যাদি – জীবনে যেন ভয় পাওয়াটা অক্সিজেনের মতোই জরুরি, ভয় না পেলে যেন জীবনই ব্যর্থ- “ভয় তো পেতেই হয় নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়”।কাজেই আমরাও এই মোটোকে একমাত্র ব্রত করে, জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন রকম ভয় পাওয়ার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছি। ঠিক কত রকম ভয় হয় এর হিসেব পৃথিবীর সবথেকে ভীতু মানুষের কাছে চাইলে সেও হিচকি তুলবে। তাই আমিও ‘ভয়’-এর এনসাইক্লোপিডিয়া রচনায় না গিয়ে, কেবলমাত্র একটি সারসংক্ষেপ দেওয়ার চেষ্টা করছি।
একদম শিশু অবস্থায়- নাহ্, শিশু অবস্থা কেন ভয় পাওয়ার শুরু তো সেই মাতৃগর্ভ থেকেই– ক্লিনিক, ডাক্তার, স্টেথো, ইউ এস জি মেশিন– এই রে এই বুঝি মারা পড়লাম। এছাড়া ছোট বড় আরো কত্ত ভয়। পৃথিবীতে এসেও কি আর শান্তি আছে– চোখ ফোটার সাথে সাথেই চোখে লাগা প্রথম আলো থেকে ভয় কিংবা কানে আসা প্রথম শব্দ থেকে ভয়,বা ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখে ভয়; এ ছাড়া নার্সের চোখ গরম কিংবা আয়া মাসির ধমক বা আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে গাল টেপা খাওয়ার ভয়; তখনই আর কি বোঝা সারা জীবন আসলে ভয়-ময়।
সবে তো শুরু, বয়স বাড়ার সাথে সাথে ভয়ও পাল্লা দিয়ে বাড়ে বই কমে না। একটু বড় হতে না হতেই খাবার না খাওয়ার সাথে যেমন জুড়ে দেওয়া হয় যুযুর ভয় তেমনি দুপুরবেলা না ঘুমনোর সাথে যোগ হয় ছেলেধরার ভয়। যুযু আর ছেলেধরার ভয়ের সাথে খানিকটা মানিয়ে নিতে না নিতেই স্কুল নামক একটি ভয়ঙ্কর জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়ার ভয় পেয়ে বসে– “চুপটি করে ব’সো না হ’লে কিন্তু স্কুলে পাঠিয়ে দেব”, “সবটুকু ভাত পরিস্কার করে খাও নইলে, কিন্তু বোর্ডিং-এ পাঠিয়ে দেব”, “সময়ে স্নান সারো দুপুরে ঘুমোও নিজের কাজ নিজে করো”, “নিয়মানুবর্তীতা মেনে চলো; না হলে কিন্তু বাড়ির বদলে জায়গা হবে বোর্ডিং-এ”। শেষমেশ সেই ভয়ানক দিন এলো, আর ভয়েভয় পা দিতে হ’ল স্কুল নামক সেই জায়গাটিতে– বুঝলাম যতটা শুনেছিলাম এ জায়গাটা তার চেয়েও ভয়ঙ্কর– দিদিমণি মাস্টার মশাইয়ের রাঙানো চোখের ভয়, বাড়ি গিয়ে পড়তে বসার ভয়, পড়া না পারার ভয়, কঞ্চিপেটা খাওয়ার বিখ্যাত ভয়। ‘পড়াশোনা করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে ‘- দিনরাত কানের কাছে জপমন্ত্র শুনে শুনে ভয় জন্মালো যে পড়াশোনা না করলে বুঝি গাড়ি ঘোড়ায় চড়া যায় না, আর এর সাথে ফেউ স্বরূপ যোগ হল আরো একগুচ্ছ ভয় যেমন মিথ্যা কথা বললে বিদ্যা হয় না, দুর্গা পুজোয় অঞ্জলি না দিলে সিওর গোল্লা, সরস্বতী পুজোর আগে কুল!! – ব্যাস বারো বছর তবে একই ক্লাসে এবং সর্বশেষে প্রয়োগ হত বাবা মা’র ব্রক্ষ্মাস্ত্র – খারাপ রেসাল্ট যদি করো বাপু ছেলে হলে রিক্সা চালাবে, আর মেয়ে হলে রিক্সাওয়ালার সাথে বিয়ে হবে। শিশু মন, এতো কী সয়? – ভয়, তিনি কী ভয়ানক।
‘নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল,
বসন্তে সৌরভের শিখা জাগল॥’
ঠিক ধরেছেন, কলেজ। স্বপ্নের কলেজ, একমাত্র জায়গা যার কল্পনা স্কুলের নির্মমদিনগুলিকে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করার রসদ যোগাতোঃ একঝাঁক রঙিন প্রজাপতি, একঘেয়ে সাদাকালো স্কুলড্রেস বদলে, রঙ বেরঙের স্টাইলিশ জামা কাপড়, কলেজ ফেস্ট, ক্রাশ খাওয়া-প্রেমে পড়া, পড়াশোনার কোন নাম গন্ধ নেই- স্কুল পড়ুয়াদের ফ্যান্টাসি ওয়ার্ল্ড- কলেজ, বিশাল যুদ্ধের শেষে পুরষ্কার স্বরূপ।
“কি বে, তোর নাম কি? ১২ টার মধ্যে বয়েস কমনরুমের পেছনে চলে আসিস। দ্বিতীয়বার যেন ডাকতে না হয়।” হি-হি-হি-হি প্রথম হোচট – র্যাগিং!! দু দিন আর কলেজের পথে পা-ই বাড়াবো না। মাগো! সিনিয়াররা এত্তো ভয়ানক হয়! কলেজ যাওয়াটাও তো ভয়ের। স্কুলে ভাবসম্প্রসারণ করতে দেওয়া একটা লাইনের প্রকৃত অর্থ বুঝলাম এতদিনে- ‘যা চকচক করে তা সব সময় সোনা নয়।’তবুও হাজার হোক কলেজ তো, স্কুল থেকে ঢের রঙ্গিন। কাজেই ক্লাস বাঙ্ক, সাইকেল স্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানা, সকাল বিকাল পার্টি অফিসে যাতায়াত, প্রিন্সিপালের রুমের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনের মতো কিছু দুঃসাহসী অভিযান, এবং তার সাথে নিজেকে চে বা জিম মরিসনের সমকক্ষ ভাবতে শুরু করা- সমাজ আমিই বদলাবো। তা বেশ তো কে মানা করেছে। কিন্তু কলেজে এসে একখানা প্রেম হবে না, সেকি কথা। চে বলে কি প্রেম করতে নেই! কই কোথাও তো এমন লেখা আছে ব’লে শুনিনি। সুতরাং, শুভস্য শীঘ্রম। কিন্তু! কিন্তু! ভয় নামক বস্তুটি যে প্রেমেও থাকতে পারে, মা কালির দিব্যি বলছি কেউ কোন দিন বলে দেয় নি। এর মধ্যে অন্যতম হ’ল ব্রেকআপের ভয়। শুধু কি তাই, পার্কে বা রেস্তোরায় বসে নিরালায় দুটো কথা বলা বা হাত ধরার মতো মুহূর্ত, যা কি না উপোভোগ করার কথা, তা যত না উপোভোগ্য তার থেকে বেশি ভয়ের হয়ে দাঁড়ায়- পাড়ার দাদা দেখলো কিনা, অমুক কাকুকে ছেলের হাত ধরে ঘুরতে দেখলাম মনে হল; তার সাথে আজকাল আবার যোগ হয়েছে ক্যামেরার ভয়- কোথায় কোন ফাঁকে কে যে একটা ছবি তুলে ভাইরাল করে দেবে এই ভয়েই অস্থির। বেশ তো, তবে সিনেমাই দেখা যাক, সিনেমা হলে অন্তত এই ভয়টা নেই। তাই কি!! হাফ টাইমে টের পেলাম, ক্যামেরার লেন্সের চেয়ে, পাড়ার কাকিমাদের চোখ ঢের বেশি তীক্ষ্ণ, আর খবর পরিবেশনে তো তারা বি. বি. সি.-র রিপোর্টারদেরও অন্তত দশ গোল দেবে।
যাই হোক, এসব নানা রকম ভয় যখন খানিক গা সওয়া হয়ে এসেছে, ঠিক তখনই কলেজের স্যার ম্যাডামরা আর একটি মারাত্মক ভয় দেখিয়ে দিলেন- “ক্লাস বাঙ্ক তো অনেক হল। এবারে পরীক্ষায় ভালো পার্সেণ্টেজ না পেলে কিন্তু গ্র্যাডুয়েশনের পর বেশির ভাগ চাকরির পরীক্ষাতেই বসা যাবে না, সেটা যেন মাথায় থাকে”। বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো, ভালো পার্সেণ্টেজ না হয় না হল, অন্তত অনার্সটা টিকবে তো!!!
না ভুল করেও ভাববেন না যে এখানেই শেষ, আসলে জীবনের পরবর্তী পর্যায়ের ভয়গুলো আরো মারাত্মক। এটুকু ছিল শুধু তার ভূমিকা মাত্র। যাই হোক ‘আশায় বাঁচে চাষা’ আর আমরাও এই আশাতেই বাঁচবো যে, একদিন নিশ্চিত এই ভয় কে জয় ক’রে গাইতে পারবো – ‘নাই নাই ভয় হবে হবে জয়’।
—-কিন্তু ততদিন??? —-
ততদিন আবার কি, বেশি বেশি ভয় পাবো আর ভয় পেতে শেখাবো।
1 Comment
Riddhiman Basu · মার্চ 3, 2019 at 9:04 পূর্বাহ্ন
ভয় না পেলে ভয় কে জয় করা যায়না, এটা সত্যি। ভয় পাবার এই রেট্রোস্পেকটিভ তা বেশ ভাল লাগল। বেশ মজার ভঙিতে লেখা, কিন্তু সিরিয়াস বিশয়বস্তু।