বালুরঘাটে বৌদ্ধ-তন্ত্রের দেবী তারার উপাসনা ও এক মহান অঘোর-বৌদ্ধ সাধক

কৌশিক বিশ্বাস on

বালুরঘাটের বুকে বয়ে চলা আত্রেয়ী নদী ; এই নদী আজও বয়ে চলেছে কালের স্মৃতি। উপরিভাগ ক্রমেই ভারী হয়েছে আধ্যাত্মিকতার পলিতে। তপোভূমি নর্মদার মতো পুণ্যভূমি আত্রেয়ী বুকে করে আগলে রেখেছে বহু আধ্যাত্মিক সাধককে যারা পার করে এসেছেন সমস্ত কালের সীমা। মহাপীঠ তারাপীঠের মতো ভারতবর্ষীয় এক পন্ডিতের সাথে যোগ বালুরঘাটের এই তারা মন্দিরের। তন্ত্রসাধনার এই মহামানব, বালুরঘাটে আত্রেয়ী নদীর পার ও তারা ; একই ত্রিভুজের তিনটি বাহু। গৌড়, তন্ত্রের আকর ভূমির নাম। আদি মধ্যযুগের প্রারম্ভে প্রাচীন গৌড়ে তন্ত্র একটা স্বতন্ত্র ও স্বকীয় ধর্ম বা মত হিসেবে উঠে এসেছিল। নাগার্জুন মহাযান বৌদ্ধধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বৌদ্ধধর্মে এসে মিশেছিল স্থানীয় লোকাচার। থেরবাদে বা বুদ্ধ নিজেও যেমন সংঘে নারী অনুষঙ্গকে খানিক উপেক্ষা করেছিলেন তেমনি আদি বৌদ্ধধর্মে যত দেবদেবী এসেছে তার মধ্যে প্রথমদিকে দেবতার প্রাধান্য ছিল বেশি। আমরা গৌড়দেশীয় লোক পৃথিবীর প্রাচীন সভত্যাগুলির সাথেসাথে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলাম। দক্ষিণ ও উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে এই পার্থক্য লক্ষণীয়। প্রবাহমান কাল ধরে দেবতা নয় দেবীর প্রাধান্য হয়েছে সবার উপরে। আজও যত দেবতা আছে ; তার থেকে দেবীর সংখ্যা গুনলে তা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভারতের এক মহান সাধক, তার সাধনার তাগিদে তিব্বতে যাওয়া, বৌদ্ধগুরু পদ্মসম্ভবের সাম্য মনেস্ট্রিতে অধ্যয়ন করা, তন্ত্র সাধনার কঠিন পথ পেরিয়ে একজন বোধিসত্ত্ব হওয়া ও তার বালুরঘাটের সাধনস্থলে তারা মায়ের আরাধনা নি:সন্দেহে অনেক জিজ্ঞাসার জন্ম দেয়। পৌরানিক কাহিনী অনুসারে মেরু বা সুমেরু নামে একটি পর্বত ছিল ভারত-তিব্বতীয় সীমান্তে। পরবর্তীতে এ.এইচ.ফ্র‍্যাংক মিরু নামে একটি স্থান চিহ্নিত করেন বর্তমান কাশ্মীরের লাদাখে। তিব্বতের মানুষ এই তারার উপাসনা করতেন জল থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে। বলা ভাল বন্যার কবল থেকে বাঁচবার জন্য। তাদের দেবী ছিল তারা বা তরণী। আবার পাহাড়ি এলাকায় বিভিন্ন জলময় হ্রদ পার হতেও এই তারাদেবীকে স্মরণ করা হতো। তাদের বিশ্বাস এইভাবে জল যোগাযোগের ক্ষেত্রে তারার স্মরণ নিলে সহজেই বিপদমুক্ত পারাপার করা যায়। তারাকে নীলসরস্বতীও বলা হয়। গায়ের রঙ সমুদ্রের নীল জলের মতো হবার কারণে। তারার ধরণী তিব্বতীয় ভাষায় – “ S Grol-madkar snon-gyi bs tod-pa gzuns”। কিন্তু নালন্দায় পাওয়া একটি তারামূর্তি ও তার গায়ে খোদিত লিপি ” ওঁ তারে তু তারে তুরেও স্বাহা ” – এই তারাদেবীকে প্রতিষ্ঠিত করে তন্ত্রের সিদ্ধিদাত্রী হিসেবে। বাংলার এই তারা সাধনায় তন্ত্র ও বৌদ্ধধারার যোগ, এক মহাসাধকের তারা উপাসনা ও বালুরঘাটের আত্রেয়ী আজ একই পঙক্তিতে দাঁড়িয়ে!

…………. পরবর্তী কিস্তিতে।

পড়ুনঃ দ্বিতীয় কিস্তি।

ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


কৌশিক বিশ্বাস

তরিকুল্লাহ সরকার উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক। আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধ লেখক। বৌদ্ধ ইতিহাস, ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখক।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।